"হে আল্লাহ!! আমাদের পিতা-মাতাকে মাফ করে দিন"-বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে কৃষিবিদ সন্তানের স্মৃতিচারণ

Category: কৃষিবিদ ও ক্যাম্পাস Written by agrilife24

ড. মুহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন:দুমেড়ে মুচড়ে উৎকণ্ঠায় কখনো বেদনার মূর্ছনায় জর্জরিত আজকের এ দিন! অত্যন্ত বিমূঢ় বিধুর ভারাক্রান্ত ব্যাথাতুর হৃদয়ে আকাশ বিদূরী হাহাকার চিৎকার করে কেন জানি বারবার নাড়া দিচ্ছে প্রস্তুত হবার জন্য! আজ কিংবা কাল চলে যেতে হবে আমাকে/আপনাকে! আমার আব্বুও চলে গেলেন ওপারে। আমার জন্মদাতা পিতা শ্রদ্ধেয় মরহুম মুহাম্মদ হাফিজ উদ্দিন আহমদ আজকের এই দিনে ১৮ মে ২০২০ ইং (৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৭, ২৫ রমজান ১৪৪১) আমাদের ৪ ভাই ১ বোনসহ অসংখ্য আত্বীয় স্বজন ও গুনগ্রাহীকে এতিম করে কবর অতিথি হয়েছেন।

"রাব্বানাগফিরলী ওলিওয়ালিদাইয়া ওয়ালিলমু’মিনীনা ইয়াওমা ইয়াকূমুল হিছা-ব (কুরান ১৪ঃ ৪১)।"রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা (কুরান ১৭ঃ ২৪)।

কর্মের বলয়ে যতবার যেখানেই যাইনা কেন-মোবাইল কল যেন বাজতেই থাকতো---কোথায় তুমি? খাওয়া-দাওয় করেছ?? ইত্যাকার উপচিকীর্ষাগুলো আব্বুর মতো বলার আর কেহ নেই!! চলে গিয়েছেন তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জিম্মায়। আর দেখা হবেনা!! বলা হবেনা!! না বলা অনেক কিছু!! এই ব্যাথার অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই কম-বেশ রয়েছে বৈকি! সান্তনা এতটুকু---আব্বুর সাথে ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালের ৩ নং কেবিনে ৪ দিন পরে আইসিইউ না থাকার কারণে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ৫ দিন ছিলাম। দাঁতের ক্যান্সারের কারণে মেডিক্যাল এর খাবার ঝাল মনে করে খেতে চাইতো না আব্বু। ভোজ বাড়ী রেস্টুরেন্ট-এর মালিকের সাথে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলেকয়ে আব্বু যা খেতে চাইতো (ঝাল ছাড়া) তাই চেষ্টা করেছি। কিন্তু আব্বুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় পাশে থাকার নসিব হয়নি আমার। মার সময় ও হয়নি আবার শ্বশুড় মহোদয়ের সময় ও হয়নি (কর্মস্হল অনেক দূর বলে)।

আব্বুর প্রথম জানাজা নামাজ ও পড়তে পারি নাই। কভিড এর কারণে রাস্তা ব্লক ছিল। বহু সংখ্যক ড্রাইভার, পুলিশ কর্মকর্তাদের কান্নায় জর্জরিত গভীর শ্রদ্ধাচারণ করে আমাকে উপস্থিত হতে হয়েছে আব্বু নামক লাশের সামনে। পরে গভীর রাতে আমি নিজেই আব্বুর আরেকটি জানাজা পড়াই। কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে।

আব্বু ছিলেন আমাদের পরিবারের আদর্শ, নির্ভরতার প্রতীক, প্রেরণার উৎস, জীবন গঠনের দায়িত্বশীল এক স্বর্গীয় বিস্ময়কর প্রতিষ্ঠান। আমার অস্তিত্ব জুড়ে তাঁর নেক বাসনার দায়িত্বগুলো সৃষ্টিকর্তার এক অপরূপ গুণী প্রদীপের আলোকিত কীর্তন হয়ে দোলা দিচ্ছে বারংবার। সমাজের নানামুখী সেবা ও উন্নয়মুলক কাজের জন্য আব্বুকে চোখ বন্ধ করলেই একাকিত্তে দেখি শতবার। সমাজ, সংসার, ধর্ম, শিক্ষা, রাজনীতি সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি ছিলেন আমার দেখা একজন মানবিক সমাজ সেবক, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। একজন অন্যতম সংগঠক হিসেবে সমাজের নানামুখী কাজে তিনি জড়িত ছিলেন নিবিড়ভাবে।

বৃষ্টি হবার পর রাস্তাঘাটে আমাকে নিয়ে অসংখ্য গাছ লাগিয়েছেন বহুবার। আবার, পশ্চিম গাঁও সমাজ কল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে একজন নিবেদিত সমাজ সেবক, নিরবিচ্ছিন্ন কর্মী, শিক্ষানুরাগী হিসেবে গ্রামের বিশিষ্ট দেশপ্রেমীদের সাথে আব্বু শক্তিগড় খ্যাত প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন দৃঢ়চিত্তে। ১৯৮১ সালে বড়দের শিক্ষাদান কর্মসূচির মাধ্যমে নিরক্ষর মুরুব্বিদের অনেকের সাথে পাঠদান জুগিয়েছিলেন আব্বু। হজরত মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (শ্রেষ্ঠ দেওবন্দি আলেম যিনি বট গাছ মার্কায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছিলেন) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমগাঁও মাদ্রাসা-ই-ইসলামিয়া জামেউল উলুম এর নানামুখী কল্যাণে আব্বু পরিচালনা পর্ষদের সহ-সভাপতি হিসেবে অনেকের সাথে বহু উন্নয়নমুলক কাজ সম্পন্ন করে গিয়েছেন।

গ্রাম সরকার হিসেবেও নানামুখী উন্নয়নের অবদান রেখে গিয়েছেন। আশির দশকে ইউপি পরিষদে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আব্বুই প্রথম কেওঢালা এবং পশ্চিমগাঁও খালে পাকা ব্রিজের সুচনা করে গিয়েছেন (পশ্চিমগাঁও খালটি বর্তমানে ভরাটকৃত)। ঢাকার কাছে হলেও আমাদের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েত পাড়া ইউনিয়নের পশ্চিমগাঁও গ্রামটি অবেহেলিত, ডুবা নালা বলে নৌকা পথে পারাপার করা লাগতো আমাদের। আব্বুর সফল প্রচেষ্ঠায় আমরা সকল ভাই-বোন শিক্ষার আলো পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ!! এমনি করে স্কুল থাকার কারণে আমদের গ্রাম থেকে বহু সংখ্যক সরকারী/বেসরকারী কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা, ডক্টর, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষিত সফল ব্যবসায়ী আজ আল্লাহর রহমতে প্রায় ঘরে ঘরে। তাইতো কবর, ঈদগাহ, মাদ্রাসা প্রভৃতির উন্নয়নমুলক কাজে এবং দুস্থ লোকের পাশে আজ শিক্ষিত যুবকদের অংশগ্রহণ দেখে মুগ্ধ হই যা কিনা পূর্বসূরীদের প্রতিফলন মাত্র। এমনি করে নেক আমল বাড়িয়ে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে চাই।

আসুন কবরে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হবার জন্য তিনটি আমলের বিষয়ে যত্নবান হই--জন কল্যাণে অভিনবত্ব (Novelty), দানশীলতা (Charity), নেক সন্তান-সন্ততির কামনা (Good children/ offspring having with islamic integrity)। উক্ত তিনটি গুন আল্লাহপাক আব্বুর/আমাদের জন্য কবুল করুক। পৃথিবী আপনাকে হারালেও আপনার কর্মযজ্ঞে নানামুখী গুণের জন্য আমাদের পাঁজরকোনে থাকবেন আমরণ। হে আল্লাহ! আপনি আমার আব্বুর ওমরা হজ্জসহ নেক প্রচেষ্টাগুলো কবুল করুন। যে কোন একটি নেক প্রচেষ্টার বদৌলতে আব্বুকে ক্ষমা করে দিন। আব্বুর পক্ষে আপনাদের কাছেও (পশ্চিম গাঁও বাসী) ক্ষমা চাই, দোয়া চাই। সকল কবরবাসিদের সম্মানিত করুন। আমিন!!

"আমরা তো আল্লাহরই এবং আর নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী"। আমাদের সকলকে কল্যাণময় জীবন দান করুন।আমিন!!

লিখেছেন-উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট