আধুনিক কৃষিতে স্প্রে ড্রোন

Category: এগ্রিবিজ এন্ড টেক্ Written by Shafiul Azam

সমীরণ বিশ্বাস:আধুনিক কৃষিতে স্প্রে ড্রোন একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রচলিত হাতে বা যান্ত্রিক স্প্রে পদ্ধতিতে সময়, শ্রম ও খরচ বেশি লাগে এবং কীটনাশক বা সার প্রয়োগে সমতা বজায় রাখা কঠিন হয়। কিন্তু ড্রোনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট উচ্চতা ও গতিতে ফসলের উপর স্প্রে করা যায়, যা নির্ভুল ও সমানভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করে। এতে কীটনাশকের অপচয় কমে, ফসলের ক্ষতি হ্রাস পায় এবং কৃষকের শ্রম অনেকটাই সাশ্রয় হয়। বিশেষ করে দুর্গম বা জলাবদ্ধ জমিতে ড্রোনের ব্যবহার অত্যন্ত কার্যকর। এছাড়া ড্রোন প্রযুক্তি মাটির আর্দ্রতা, ফসলের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি অবস্থাও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম, যা স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থার অংশ। ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও পরিবেশবান্ধব কৃষি নিশ্চিত করতে স্প্রে ড্রোন আধুনিক কৃষিতে এক অবিচ্ছেদ্য উপকরণে পরিণত হয়েছে।

বিশ্ব কৃষিতে স্প্রে-ড্রোন বাজার :

২০২৪ সালে ‌কৃষি ফসল স্প্রে করার ড্রোনের বাজার ২.৪৭ বিলিয়ন USD, ২০২৫ সালে ৩.৪১ বিলিয়ন USD, এবং ২০২৯ সালের মধ্যে ১০.৮৬ বিলিয়ন USD-এ পৌঁছাবে , তা বাজার-বৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের দিশায় ভালো ইঙ্গিত দেয়।

বিশ্লেষণ করা হলে, প্রথমত, এই বৃদ্ধির হার অত্যন্ত উচ্চ। ২০২৪ থেকে ২০২৫-এ বাজার প্রায় ৩৪ % (২.৪৭ থেকে ৩.৪১) বাড়ছে, এবং ২০২৫ থেকে ২০২৯-এ (৩.৪১ থেকে ১০.৮৬) প্রায় তিনগুণের বেশি হওয়ার কথা। এই রকম দ্রুত বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণ। যেমন, অত্যাধুনিক স্প্রে ড্রোন-প্রযুক্তি, কৃষিতে স্বয়ংক্রিয়করণ, শ্রমশক্তি সংকট, এবং পরিবেশ-দক্ষতা বাড়ানোর চাহিদা। উদাহরণস্বরূপ, এক প্রতিবেদন বলছে যে, গ্লোবাল কৃষি-ড্রোন বাজার ২০২৪ সালে USD 2.71 বিলিয়ন ছিল এবং ২০২৫-৩৩ পর্যন্ত ২৭.৯৭% CAGR-এ বাড়বে।

দ্বিতীয়ত, এই বাজারের বৃদ্ধিতে ভূগোলও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৃষি-ভিত্তিক জমি বেশি ও প্রযুক্তি গ্রহণ দ্রুত হচ্ছে , ফলে স্প্রে ড্রোনগুলোর চাহিদাও বেশি। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারগুলোতে ড্রোন স্প্রে সিস্টেম দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে।

তৃতীয়ত, যদিও ১০.৮৬ বিলিয়ন USD-র লক্ষ্যমাত্রাটি গত কোনো প্রতিবেদনে নির্ধারিত নয় , বিভিন্ন উৎসে বিভিন্ন রূপ দেওয়া হয়েছে। যেমন, IMARC Group বলছে ২০২৪ সালের বাজার USD 2.706 বিলিয়ন ছিল এবং ২০২৫-৩৩ সময়কালে USD 31.882 বিলিয়ন হতে পারে, অত্যাধুনিক কৃষি স্প্রে ড্রোন-প্রযুক্তি । 

কৃষি স্প্রে-ড্রোন বাজার দ্রুত বাড়ছে এবং এর মূল চালক হচ্ছে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, কৃষিতে দক্ষতা বাড়ানোর চাহিদা, ও বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ও সাপ্লাইয়ের চাপে আধুনিক সরঞ্জামের প্রতি ঝোঁক। আপনার দেয়া পরিসংখ্যান উন্নয়নের ধারায় অর্থপূর্ণ হলেও, বৈচিত্র্যময় উৎসের মধ্য থেকে একটু পরিমিত প্রত্যাশা বজায় রাখা যুক্তিসঙ্গত হবে।

বাংলাদেশের কৃষিতে স্প্রে ড্রোন সম্ভাবনা:

আধুনিক কৃষিতে স্প্রে ড্রোনের ব্যবহার বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রযুক্তিনির্ভর এই উদ্ভাবন শুধু শ্রম ও সময় বাঁচাচ্ছে না, বরং উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের কৃষক সমাজ এখনও অনেকাংশে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল, যেখানে কীটনাশক বা সার ছিটাতে প্রচুর সময় ও শ্রম ব্যয় হয়। ফলে অনেক সময় সঠিক সময়ে ফসল রক্ষা সম্ভব হয় না। কিন্তু স্প্রে ড্রোন ব্যবহার করলে কয়েক মিনিটেই একটি বৃহৎ জমিতে সুষমভাবে কীটনাশক বা সার ছিটানো সম্ভব, যা ফসলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ফলন বাড়ায়।

স্প্রে ড্রোন প্রযুক্তি দূষণও কমায়, কারণ এটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ সঠিকভাবে ছিটায়, ফলে অপচয় বা অতিরিক্ত প্রয়োগের সম্ভাবনা থাকে না। এছাড়া শ্রমিক সংকট বা প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও ড্রোনের সাহায্যে সহজে স্প্রে করা যায়, যা কৃষকের জন্য বিশাল সুবিধা। বিশেষ করে ধান, গম, ভুট্টা ও শাকসবজি চাষে এর কার্যকারিতা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এই খাতে ইতোমধ্যে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছে, যা কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে: ACI Motors এবং সিনজেনটা ফাউন্ডেশন স্প্রে ড্রোন প্রযুক্তি বাস্তবায়নের দিকে উল্লেখ করেছে। ICONIC Engineering কৃষিতে ড্রোন সলিউশন নিয়ে কাজ করছে। Sky Bees Limited উৎপাদন দিকে ফোকাস করছে এবং কৃষি স্প্রে উদ্দেশ্যে ড্রোন তৈরির পরিকল্পনায় রয়েছে। এছাড়া জিনিয়াস ফার্মস লিমিটেড (GFL) এবং FLYMEK যৌথ উদ্যোগে যথাক্রমে মাঠ পর্যায়ে স্প্রে ড্রোন পাইলটিং করা এবং ড্রোন উৎপাদন এবং বিপননে কাজ করছেন। যদি সরকার ও বেসরকারি খাত যৌথভাবে এই প্রযুক্তিকে আরও বিস্তৃত করে, তাহলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে, খরচ কমবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা আরও সুদৃঢ় হবে। তাই বলা যায়, স্প্রে ড্রোন বাংলাদেশের কৃষিকে আধুনিকায়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে।

আধুনিক কৃষিতে স্প্রে ড্রোনের ব্যবহার কৃষি ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। প্রযুক্তিনির্ভর এই পদ্ধতি শুধু সময় ও শ্রম বাঁচাচ্ছে না, বরং নির্ভুলভাবে কীটনাশক ও সার প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করছে। ঐতিহ্যগত হাতে স্প্রে করার তুলনায় ড্রোন প্রযুক্তি দ্রুত, কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব। এটি কঠিন ভূপ্রকৃতি বা দুর্গম এলাকায়ও সহজে কাজ করতে পারে, ফলে কৃষকদের ঝুঁকি কমে এবং খরচও হ্রাস পায়। পাশাপাশি, ড্রোনের ডেটা বিশ্লেষণ সুবিধা কৃষকদের ফসলের রোগ, পোকামাকড় আক্রমণ ও পুষ্টির ঘাটতি সম্পর্কে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। তাই বলা যায়, স্প্রে ড্রোন আধুনিক কৃষিকে স্মার্ট, দক্ষ ও টেকসই কৃষিতে রূপান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির বিস্তৃত ব্যবহার বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তায় নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে।

লেখক:কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।