কৃষিবিদ ড. এম মনির উদ্দিন: ধান বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৪ বিলিয়ন প্রধানত এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর প্রধান খাদ্য। উভয় মহাদেশেই ধান ক্ষুদ্র কৃষকদের দ্বারা ছোট আয়তনের জমিতে উৎপাদিত হয়। ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর জনসংখ্যা বছরে ১.৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। ফলে ধান উৎপাদনের বর্তমানের বৃদ্ধির হার তাদের খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট নয়; তাই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য বার্ষিক উৎপাদন দুই মিলিয়ন টন বৃদ্ধি প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, ৯০ শতাংশেরও বেশী ধান এশিয়ায় উৎপাদিত ও খাওয়া হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১৭০ মিলিয়ন মানুষ যারা প্রধান খাদ্য হিসাবে চাল তথা ধানের উপর নির্ভরশীল।
বিগত তিন দশকে জলবায়ুগত বিরাট পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন অনেকটা কমে গেছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, জাতিসংঘ, কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) প্রতিনিধিরা বলেছেন যে, বিশ্বের বৈরী আবহাওয়া সেইসাথে জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে খাদ্য উৎপাদনও বাড়াতে হবে। এফএও ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে ৮.৯ বিলিয়ন মানুষ হবে। আগামীতে এই বিশ্ব জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে বর্তমানের চালের উৎপাদন ৫২০.৯ মিলিয়ন টন থেকে ২০৫০ সালে ৫৮৪ মিলিয়ন টনে বৃদ্ধি করতে হবে।
এশিয়ার অনেক দেশে সবুজ বিপ্লবের ২০ বছরের মধ্যে দ্রুত উন্নত জাতের সম্প্রসারণ, ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো এবং নিবিড় উপকরণ ব্যবহারের ফলে ধানের ফলন দ্বিগুন হয়েছে। ফলস্বরূপ, ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকে বিশ্বব্যাপী ধান উৎপাদন প্রতিবছর ২.৩-২.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। ১৯৯০ এর দশকে বৃদ্ধির হার ১.৫ শতাংশে নেমে আসে এবং একুশ শতকের প্রথম দশকে প্রধানত জলবায়ু পরিবর্তন, ভুমিক্ষয় ও উর্বরতা হ্রাসের কারনে আরো কমে আসে। নিবিড় ধান চাষের ফলে ১৯৯০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী কৃষি গ্রীণহাউজ গ্যাস নির্গমন প্রায় ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
শীর্ষ ধান উৎপাদনকারী ২০টি দেশের উপর গবেষণায় উঠে আসে যে, ধান চাষের কারনে কম্বোডিয়ায় সর্বোচ্চ মিথেন গ্যাস নির্গমন হয়। তারপরের অবস্থানে থাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। মাথাপিছু সর্বোচ্চ পরিমানে গ্রীনহাউজ নির্গমন রেকর্ড করা হয় থাইল্যান্ডে যার পরিমান ১৫৯৫.২৪ কেজি কার্বন ডাই অক্সাইড সমতুল্য, কম্বোডিয়ায় ১৫১৭.২১ কেজি এবং বাংলাদেশে ৭০৬.৭২ কেজি। ধান চাষের জন্য মোট গ্রীণহাউজ গ্যাস নির্গমনের পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষ ২০টি ধান উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ যার পরিমান প্রতি হেক্টরে ৯,৯০৩.০৩ কেজি এবং এই নির্গমনে সেচের পানি ব্যবস্থাপনা এবং রাসয়নিক সারের প্রভাব যথাক্রমে ৩০ ও ৬.৫ শতাংশ।
প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে গ্রীণহাউজ গ্যাসের নির্গমন চীনে ৫.৮৭ কেজি, থাইল্যান্ডে ৩.৯১ কেজি এবং ভারতে ৩.৪৪ কেজি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২৩ সালের আমন মৌসুমে চালের উৎপাদন ছিল ১৫ মিলিয়ন টন, আউশে প্রায় ৩.৩১ মিলিয়ন টন এবং বোরোতে প্রায় ২০ মিলিয়ন টন। সব মিলিয়ে দেশে ২০২৩ সালে ধানের হিসেবে মোট উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৫৭ মিলিয়ন টন। ১ কেজি ধান উৎপাদন করতে বাংলাদেশে গ্রীণহাউজ গ্যাস; কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হয় শুস্ক ও ভেজা মৌসুমে যথাক্রমে ২.২১ ও ১.৭০ কেজি। সেই হিসেবে দেশে ২০২৩ সালে বোরো ধান চাষে গ্রীণহাউজ গ্যাস; কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হয়েছে ৬৮.৫১ মিলিয়ন টন এবং আউশ ও আমন মিলে নির্গমন হয়েছে ৪৪.২ মিলিয়ন টন।
বৈশ্বিক কৃষি খাদ্য ব্যবস্থায় ফসলের ফলন বাড়ানোর জন্য রাসয়নিক ইউরিয়া সার গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালন করে যদিও এটি পরিবেশের জন্য মোটেই টেকসই নয়। ২০১৮ সালের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ইউরিয়া বিশ্বব্যাপী ১.১৩ গেগা টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী যা বৈশ্বিক কৃষি নির্গমনের ১০.৬ শতাংশ এবং বিশ্বব্যাপী গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনের ২.১০ শতাংশ। ইউরিয়া সারের এই গ্রীণহাউজ গ্যাস নির্গমনের ৩৮.৮ শতাংশ ছিল উৎপাদন জনিত, ৫৮.৬ শতাংশ মাঠ পর্যায়ে ব্যবহারের কারনে এবং বাকী ২.৬ শতাংশ পরিবহন জনিত কারনে। আগামীদিনে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে প্রবনতা তা কমিয়ে ফসল উৎপাদনে ইউরিয়া সারের কারনে যে পরিবেশ দুষণ তা কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অবশ্যই বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে মানুষের জন্য যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার জন্য কৃষির কারনে যে গ্রীণহাউজ গ্যাস নির্গমন বেড়ে চলছে তার রশিকে টানতেই হবে। এ জন্য ২১০০ সালের মধ্যে ইউরিয়া সারের দক্ষতা ৭০ শতাংশের উপর বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে বাৎসরিক মোট ইউরিয়া সারের চাহিদা ৩.৪ মিলিয়ন টন যার ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ২.৭২ মিলিয়ন টন শুধুমাত্র ধান চাষে ব্যবহার করা হয়। সেইসাথে, ধান চাষে ডিএপি সার ব্যবহার হয় মোট ১.৬ মিলিয়ন টন যার মধ্যে ইউরিয়ার পরিমান ১৮ শতাংশ অর্থাৎ ০.২৯ মিলিয়ন টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে দেশে মোট সারের চাহিদা ৬.৮৪ মিলিয়ন টন যার মধ্যে রয়েছে ইউরিয়া, ডিএপিসহ ১১টি সার। বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষকই ধানের জমিতে ছিটিয়ে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে যার গ্রহন বা ব্যবহার দক্ষতা মাত্র ৩০-৩৫ শতাংশ এবং ৬৫-৭০ শতাংশই বিভিন্নভাবে পরিবেশের সাথে যুক্ত হয়ে অপচয় হয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র ধান চাষে বছরে দেশে ইউরিয়া সারের মোট অপচয় হয় প্রায় ১.৬৫ মিলিয়ন টন যার আর্ন্তজাতিক বাজার মুল্য ১,৫৮,৪০০ মিলিয়ন টাকা।
ইউরিয়া সারের অপচয় রোধ তথা দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ১৯৩০ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণা চলতে থাকে তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, কষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, পরমানু কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট আশির দশকে ইউরিয়া সারের অপচয় রোধের উপর গবেষণা চালিয়ে অত্যন্ত সফলতার সাথে গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে যার মাধ্যমে ইউরিয়া সারের অপচয় কমিয়ে আনা যায় এবং এতে প্রায় ৪০ ভাগ ইউরিয়া সাশ্রয় হয়। সারের কার্যকারীতা বেড়ে যাওয়ায় ধানের ফলনও ২৫-৫০% পর্যন্ত বেড়ে যায়।
গুটি ইউরিয়া, ইউরিয়া সারেরই একটি রূপান্তর মাত্র অর্থাৎ গুড়া ইউরিয়াকে ব্রিকোয়েট মেশিনের মাধ্যমে চাপ দিয়ে ন্যাপথলিনের মত গুটি তৈরী করা হয় যার ২.৭ গ্রাম ওজনের একটি গুটি বোরো ধান লাগানোর ৭-১৫ দিনের মধ্যে প্রতি চার গোছার মাঝখানে ৭-১০ সেমি. গভীরে পুতে দেওয়া হয় আর আমনের ক্ষেত্রে একইভাবে ১.৮ গ্রামের ১টি গুটি ব্যবহার করা হয়। এতে বোরো ধানে হেক্টর প্রতি গুটি ইউরিয়ার দরকার হয় ১৭০-২৪০ কেজি (চারার দুরত্বের ভিন্নতার কারণে) আর আমনের ক্ষেত্রে দরকার হয় ১১৫-১৫০ কেজি।
গুটি ইউরিয়া কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে সাহায্য করে সেইসাথে ফলনও বাড়ে। জমিতে ধানের চারা লাগানোর ৭-১৫ দিনের মধ্যে গুটি ইউরিয়া একবার ব্যবহার করলেই ধান কাটা পর্যন্ত আর ইউরিয়া সার ব্যবহার করার দরকার হয় না এবং গাছে ইউরিয়াজনিত গুপ্তক্ষুধা থাকেনা। গুটি ইউরিয়া যেহেতু মাটির নীচে পুতে দেয়া হয় যার কারণে আগাছা সারের উপর ভাগ বসাতে পারে না। এর ফলে আগাছার পরিমান খুবই কমে যায় যা নিড়ানী খরচ কমাতে সহায়ক হয়। অথচ গুড়া ইউরিয়া ছিটিয়ে প্রয়োগ করলে ধান গাছের আগে আগাছা সার গ্রহণ করার সুযোগ পায় কারন আগাছার শিকড় মাটির উপরের দিকে থাকে এবং এতে যত বার ইউরিয়া সার ছিটানো হয় ততবার নিড়ানী দরকার হয়। গুটি ইউরিয়ার ক্ষেত্রে একটি নিড়ানিই যথেষ্ট।
ধানের শীষ উৎপাদন পর্যায়ে যদি নাইট্রোজেনের অভাব বা গুপ্তক্ষুধা থাকে তাহলে ফলন অনেক কমে যায়। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে ধান গাছ সবসময় তার প্রয়োজন অনুযায়ী নাইট্রোজেন পায় বিধায় শীষ উৎপাদন পর্যায়ে নাইট্রোজেনের কোন অভাব থাকেনা। এর ফলে ফলন বেড়ে যায়। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করা জমিতে গুছিতে শীষবাহী কুশির সংখ্যা বেড়ে যায়, দানার আকার পুষ্ট হয় যার কারণে বেশী ফলন পাওয়া যায় এব পর্যাপ্ত নাইট্রোজেন গ্রহন করায় দানায় এ্যামাইনো এসিড বেড়ে যায় যা প্রোটিন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। গুটি ইউরিয়া ব্যবহারে নাইট্রোজেনের অপচয় কমিয়ে দেয় যায় যা ক্ষতিকারক গ্রীণহাউজ গ্যাস নির্গমন উল্লেখযোগ্য পরিমানে কমাতে সহায়ক।
কোন দেশ যখন কোন পণ্য বা সেবার জন্য বিদেশ নির্ভর থাকে তখন সরবরাহ চেইনের যে কোন পর্যায়ে বাঁধা বা সমস্যার সম্মুখীন হওয়া স্বাভাবিক। যেমন কোভিড-১৯ ও রাশিয়া ইউক্রেন সংঘাতের কারনে বাংলাদেশ সারের সংকটে পড়ে এবং বেশী দামে সার আমদানী করে কৃষকের কাছে সাশ্রয়ী করতে ভর্তুকি মুল্যে সরকার কৃষকের সাধ্যের মধ্যে কম দামে সার বিক্রয় করে। সরকার প্রতি কেজি ইউরিয়া সার আমদানী করে ৯৬ টাকা দরে এবং কৃষকদের কাছে ভর্তুকি মুল্য দিয়ে বিক্রয় করে ২৬ টাকায় যাতে কৃষকের ফসল উৎপাদন খরচ কম পড়ে। অর্থাৎ সরকার প্রতিটন ইউরিয়া সারে ভুর্তকি দিচ্ছে ৭০ হাজার টাকা। পক্ষান্তরে, দেশীয় ইউরিয়া উৎপাদন প্ল্যান্টগুলোতে এক টন ইউরিয়া সার উৎপাদনের জন্য ৪৩.৭২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস খরচ হচ্ছে যেখানে অন্যান্য দেশ একই পরিমান সার উৎপাদন করতে মাত্র ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করছে। ফলে দেশীয় ইউরিয়া সার উৎপাদনেও খরচ পড়ছে অনেক বেশী।
কৃষক যারা একবার গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করেছে তারা পুনরায় ব্যবহার করতে চায় কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থাপনায় গুটি ইউরিয়া সহজলভ্য করার কথা থাকলেও বাস্তবে বাজারে গুটি ইউরিয়া পাওয়া যায় না। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ এই যে, এই চমৎকার পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তিটি নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার এবং গুড়া ইউরিয়ার পরিবর্তে ধান চাষে কৃষকের হাতে গুটি ইউরিয়া তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যার মাধ্যমে দেশের ইউরিয়া সারের সাশ্রয় করবে, ইউরিয়া সার আমদানীজনিত দেশীয় মুদ্রার সাশ্রয় হবে, কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে, ক্ষতিকারক গ্রীণহাউজ গ্যাসের নির্গমন উল্লেখযোগ্য পরিমানে কমে যাবে, ধানের ফলন বাড়াবে, এ্যামাইনো এসিড বৃদ্ধির মাধ্যমে চালে প্রোটিনের পরিমান বেড়ে যাবে এবং দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
লেখকঃকনসালট্যান্ট
গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড্ নিউট্রিশন (গেইন), বাংলাদেশ