মহররম মাস ও আশুরার আমল

Category: ইসলাম ও জীবন Written by agrilife24

ইসলামিক ডেস্ক:হিজরি বছরের প্রথম মাস হলো মহররম। হিজরি সন মুসলমানদের জন্য নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের সব বিধান প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িত। আর এ মাস যেহেতু হিজরির সূচনা মাস। তাই এই মাসটি নতুন বছরে বিগত বছরের ত্রুটি কাটিয়ে নতুন প্রত্যয়ে নিজেদের জীবন পরিচালনার জন্য মাইলফলক। আরো বিভিন্ন দিক বিবেচনায় এ মাসটি আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। এ মাসেরই দশম তারিখকে বলা হয় ‘আশুরা দিবস’।

কুরআন-সুন্নায় এ মাস ও দিবসের অনেক ফজিলত ও গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। বিশেষত আশুরা দিবসটি এতে সবিশেষ গুরুত্ব রাখে। আশুরা দিবসের পাশাপাশি পুরো মহররম-ই মুমিনদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এ মাসের ব্যাপারে বলেছেন ‘আল্লাহ যেদিন আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তায়ালার নিকট তার বিধান মতে বারোটি। এর মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন। কাজেই এ মাসগুলোতে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।’
(সুরা আত তাওবা, আয়াত নং ৩৬)

এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা চারটি মাসকে সম্মানিত মাস বলে অভিহিত করেছেন। আর সে চারটি মাস হলো, রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম।
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম সিয়াম হলো আল্লাহর মাস মহররমের সিয়াম। আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামাজ)।’ (সহিহ মুসলিম, হা. নং ১১৬৩)

মহররম মাসের সবচেয়ে মহিমান্বিত দিন হচ্ছে ‘আশুরা দিবস’ তথা মহররমের দশ তারিখ। আশুরা দিবস গুরুত্বপূর্ণ হওয়া এবং এদিনে সিয়াম পালনের কারণ হলো, আল্লাহ তায়ালা মুসা আলাইহিস সালাম ও তার সম্প্রদায়কে এই দিন জালেম ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তিদান করেছিলেন।

যেমন সহিহ বুখারিতে এসেছে- ‘ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইহুদিরা আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? (তোমরা এদিনে সিয়াম পালন করছো কেন?) তারা বললো, এটা অতি উত্তম দিন। এই দিনে আল্লাহতায়ালা বনি ইসরাইলকে তাদের শত্রুর কবল থেকে মুক্তি দান করেছেন। ফলে এই দিনে মুসা আলাইহিস সালাম সিয়াম পালন করেছেন। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মুসা আলাইহিস সালামের অনুসরণের ক্ষেত্রে আমি তোমাদের অপেক্ষা অধিক হকদার। এরপর তিনি এ দিনে সিয়াম পালন করলেন এবং (অন্যদেরকেও) সিয়াম পালনের নির্দেশ দিলেন।’ (সহিহ বুখারি, হা. নং ২০০৪; সহিহ মুসলিম, হা. নং ১১৩০)

ইসলামপূর্ব আরব জাহেলি সমাজেও এই দিনের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা ছিল। যেমন সুনানে আবু দাউদের হাদিসে এসেছে-‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মূর্খতার যুগে কুরাইশরা আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করতো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তখন (নফল হিসেবে) এ সিয়াম পালন করতেন।

এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় আসলেন, তখন তিনি (ফরজ হিসেবে) আশুরার সিয়াম রাখলেন এবং (সাহাবিদেরকেও) এই সিয়াম পালনের আদেশ দিলেন। এরপর যখন রমজানের সিয়াম ফরজ করা হলো, তখন তা আবশ্যক হয়ে গেল। ফলে আশুরার সিয়ামের আবশ্যকীয়তা রহিত হয়ে গেল। অতএব, যার ইচ্ছা সে এ সিয়াম পালন করবে এবং যার ইচ্ছা সে পরিত্যাগ করবে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হা. নং ২৪৪২)

আশুরার দিনের মূল ইবাদত হচ্ছে এ দিনে সিয়াম পালন করা। আবু কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আশুরার সিয়ামের ফযিলতের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘আশুরার দিনের সিয়ামের ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা রাখি যে, এ সিয়াম পালন করলে তিনি পূর্বের এক বছরের (সগিরা) গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হা. নং ১১৬২)

সাহাবায়ে কেরাম এ দিনে বাচ্চাদেরকেও সিয়াম পালনে অভ্যস্ত করতেন। বিখ্যাত নারী সাহাবি হযরত রুবায়্যি বিনতে মুআববিয রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার দিন সকালে আনসারদের এলাকায় লোক মারফত এ খবর পাঠালেন- ‘যে আজ সকালে খেয়েছে সে যেন সারাদিন আর না খায়। আর যে সকালে খায়নি সে যেন সিয়াম পূর্ণ করে’।
 
ওই নারী সাহাবি বলেন, এরপর থেকে আমরা নিজেরাও এ দিনে সিয়াম পালন করতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরও সিয়াম পালন করাতাম। তাদের জন্য আমরা খেলনা বানিয়ে রাখতাম। তারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে তাদেরকে খেলনা দিয়ে শান্ত করতাম। ইফতার পর্যন্ত এ নিয়ে তাদের সময় কেটে যেত।
(সহিহ বুখারি, হা. নং ১৯৬০; সহিহ মুসলিম, হা. নং ১১৩৬)

যেভাবে পালন করবো আশুরার সিয়াম
আশুরার সিয়াম শুধু একটি রাখা ঠিক নয়। বরং তার সাথে আগে বা পরে আরেকটি সিয়াম রাখতে হবে, অন্যথায় তা মাকরূহ হবে। ফুকাহাদের থেকে এমন মতামত পাওয়া যায়। অর্থাৎ, মুহাররমের ৯ ও ১০ তারিখ কিংবা ১০ ও ১১ তারিখ মিলে যেকোনো দুটি সিয়াম রাখা। এর কারণ হলো, ইহুদিরাও ১০-ই মুহাররম সিয়াম পালন করে। তাই আমাদের ইবাদতকে তাদের ইবাদতের সাথে অমিল করার জন্য অতিরিক্ত আরেকটি সিয়াম পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশুরার সিয়াম পালন করতেন এবং অন্যদেরকে সিয়াম পালন করতে বলেছিলেন, তখন সাহাবিগণ বললেন-হে আল্লাহর রাসুল! এ দিনকে তো ইহুদি-খ্রিস্টানরা সম্মান করে? তখন নবিজি বললেন- তাহলে আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও সিয়াম পালন করবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু পরবর্তী বছর আসার পূর্বেই নবিজির ইন্তেকাল হয়ে যায়। (সহিহ মুসলিম, হা. নং ১১৩৪)

বিখ্যাত হাদিস বিশারদ ইবনে হাজার রহিমাহুল্লাহ বলেছেন-সবচেয়ে উত্তম হয়, দশ তারিখের সাথে মিলিয়ে আগে-পরে আরো দুটি রোজা রাখা। নয়, দশ ও এগারো সর্বমোট তিনটি রোযা রাখা। কারণ, পুরো মুহাররম মাসব্যাপি রোযার কথা তো সহিহ হাদিসেই আছে। (ফাতহুল বারি, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২৪৬)

উপরিউক্ত বিষয়গুলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শতভাগ বিশুদ্ধ সূত্রে  মহররম ও আশুরা দিবসের গুরুত্ব, ফজিলত ও আমল হিসেবে প্রমাণিত। এর অতিরিক্ত আমাদের সমাজে যেসব কেচ্ছা-কাহিনি ও রুসুম-রেওয়াজ আছে, তার অধিকাংশই জাল ও মিথ্যা কিংবা অনির্ভরযোগ্য ও দুর্বল বর্ণনা।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে দ্বীন পালনের তাওফিক দান করুন, আমিন।