বন্যা কালীন ও বন্যা পরবর্তী সময়ে কৃষাণ-কৃষাণী ভাইবোনদের জন্য পরামর্শ

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

মোঃ মোহাইমিনুল ইসলাম:বন্যা আমাদের দেশে একটি পরিচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু এ বছর আকস্মিক বন্যার কারনে দেড় লাখ হেক্টরের উপরে ফসলি জমি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে দেশের অপেক্ষাকৃত নিচু জমি ও বন্যা কবলিত এলাকায় আমন ধানের চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই চলতি আমন মৌসুমে আমন ধানের চাষাবাদ নির্বিঘ্ন রাখতে বন্যা কালীন ও বন্যা পরবর্তী সময়ে কৃষাণ-কৃষাণী ভাইবোনদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান করা হলো।

অপেক্ষাকৃত নিচু জমি ও বন্যা কবলিত এলাকায় ভাসমান পদ্ধতিতে তৈরিকৃত বীজতলা বা দা-পোগ বীজতলার মাধ্যমে চারা উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। ভাসমান বীজতলা সাধারণত মাটি ও কচুরিপানা দিয়ে কলার ভেলায় ভাসমান অবস্থায় তৈরি করা হয় এবং দা-পোগ বীজতলার ক্ষেত্রে কোন শুকনা জায়গা অথবা কাদাময় নরম সমতল স্থানে কলা গাছের বাকল, কাঠ বা পলিথিন দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে। সেখানে প্রতি বর্গমিটারে প্রায় ২.৫ কেজি অঙ্কুরিত বীজ ছড়িয়ে দিয়ে বীজতলা তৈরি করতে হবে। এভাবে তৈরিকৃত বীজতলা থেকে ১৮-২০ দিন বয়সের চারা জমিতে রোপণ করতে হয়।

যে সমস্ত এলাকা বন্যা কবলিত নয় সে সমস্ত এলাকায় প্রয়োজনীয় পরিমাণ বীজতলা তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে যাতে বন্যার পানি কমে যাওয়ার সাথে সাথে চারা রোপণ করে আমন ধানের আবাদ নির্বিঘ্ন রাখা যায়। বন্যা কালীন এবং বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর স্বল্প ও দীর্ঘ জীবনকালীন উফশী জাত যেমন- বিনাশাইল, বিনাধান-৭, বিনাধান-১১, বিনাধান-১২, বিনাধান-১৩, বিনাধান-১৫, বিনাধান-১৬, বিনাধান-১৭, বিনাধান-২০, বিনাধান-২২ এবং বিনাধান-২৩ জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বীজতলায় বীজ ফেলা যায়। এক্ষেত্রে বিনাধান-১১ ও বিনাধান-১২ বীজতলা কিংবা চারা রোপণের ২-৩ দিন পর ২০-২৫ দিন পর্যন্ত পানিতে নিমজ্জিত থেকে চারা ধানের উপরের অংশ পচে গেলেও মূল গাছ থেকে পুনরায় কুশি গজায় এবং ফলন ঠিক থাকে।

বন্যা কালীন ও বন্যা পরবর্তী সময়ে স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন আমনের জাতসমূহ যেমন- বিনাধান-১১, বিনাধান-১২, বিনাধান-১৬, বিনাধান-১৭, বিনাধান-২২ নির্বাচন করলে বোরো পুর্ববর্তী সময়ের মধ্যে সরিষা ও অন্যান্য ফসল চাষের জন্য শষ্য বিন্যাস ঠিক থাকে। স্থানীয় জাত যেমন-নাইজারশাইল, লাটিশাইল, রাজাশাইল ও দোলা আমন স্থানীয় জাতসমূহ ১৫ সেপ্টেম্বর এর মধ্যে রোপণ বা সরাসরি বপনের ক্ষেত্রে ৩০ আগস্টের মধ্যে বপন করতে হবে। ব

ন্যার পানি নেমে যেতে শুরু করলে নাবীতে রোপণের ক্ষেত্রে প্রতি গোছায় চারার সংখ্যা কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে (কমপক্ষে ৪ টি) এবং একটু ঘন করে রোপণ করতে হবে। উচু জায়গা যেখানে বন্যা আক্রান্ত হয়নি এরকম এলাকায় ইতোমধ্যে রোপণকৃত আমন ধানের গাছ (রোপণের ২৫-৩০ দিন পর্যন্ত) থেকে পর্যাপ্ত কুশি রেখে বাকি কুশি শিকড়সহ তুলে নিয়ে অন্য ক্ষেতে রোপণ করা যেতে পারে। বিলম্বে রোপণের ক্ষেত্রে দ্রুত কুশি উৎপাদনের জন্য সুপারিশকৃত দুই-তৃতীয়াংশ টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও ইউরিয়া সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া রোপণের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে। নাবিতে বপনের ক্ষেত্রে ধানের জন্য আশানুরুপ ফলন পেতে উচু বা খরা প্রবণ এলাকায় প্রয়োজন অনুযায়ী সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।



আগাম জাতের ধানের ক্ষেত্রে ফুল পর্যায়ে ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে থোড় অবস্থার শেষ পর্যায়ে ট্রাইসাক্লোজল ও এজোক্সিস্ট্রোবিন গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন: এমিস্টার-টপ, ট্রুপার, নেটিভো ইত্যাদি ১০ দিন ব্যবধানে দুই বার অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে। বন্যায় আক্রান্ত বীজতলায় অনেক সময় ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া রোগ দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে চারা একটু বড় হয়ে উঠলে সেক্ষেত্রে সালফার গ্রুপের যে কোন বালাইনাশক, মিউরিয়েট অব পটাশ এবং জিংক সার পরিমিত মাত্রায় পানিতে মিশিয়ে জমিতে স্প্রে করতে হবে। বন্যা পরবর্তী সময়ে জলাবদ্ধ ক্ষেতে বাদামী গাছ ফড়িং বা কারেন্ট পোকার আক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে। এজন্য নিয়মিত মাঠ পরিদর্শনের পাশাপাশি পোকার উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারলে তৎক্ষণাত আলোক ফাঁদ বা কীটনাশক যেমন- সানমেকটিন/সেগাটিন/এবামেক্স/চ্যালেঞ্জার/ ক্রাইফেট/গোল্ডস্টার/প্লাটিনাম অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।

এছাড়া এই সময় ধান ক্ষেতে মাজরা পোকা, পামরি পোকা এবং পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ হয়। সে ক্ষেত্রে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা যেমন- আলোক ফাঁদ, পার্চিং, হাত জাল এবং অনুমোদিত কীটনাশক যেমন- মাজরা পোকার জন্য সানফুরান/ভিটাফুরান/ভিরতাকো, পামরি পোকার জন্য টপটিন/লিকার, পাতা মোড়ানো পোকার জন্য সেভিন/রগর অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এভাবে কৃষাণ-কৃষাণী ভাই ও বোনেরা বন্যা কালীন ও বন্যা পরবর্তী সময়ে একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে আমন চাষাবাদে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভভ হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক:বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
ফলিত গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিভাগ,বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ-২২০২