সোনালী মুরগির ধূসর ভবিষ্যৎ

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

ড. মোঃ শরিফুল ইসলাম:সোনালি মুরগি RIR ও ফাউমি জাতের সংকরায়নে বাংলাদেশে উদ্ভাবিত একটি সংকর (ক্রস) জাতের  মুরগি। আমাদের দেশে সোনালী মুরগি উদ্ভাবন হওয়ার পর থেকেই এটি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। সোনালী মুরগির মাংসের কালার এবং স্বাদ দেশীয় মুরগির মত হওয়ায় এটি ভোক্তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এদের নামকরন এদের গায়ের রঙের কারনে দেয়া হয়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুরগির পালকের রং গাঢ় বাদামি বা সোনালি বর্ণ ধারণ করে। সোনালির পায়ের রং হলুদ হয়।

সোনালি জাতের মোরগের ওজন প্রায় ৩.২ কেজি এবং মুরগীর ওজন প্রায় ২.২ কেজি হয়ে থাকে। তবে উন্নত খাদ্য ও ব্যাবস্থাপনায় ওজন আরো বেশি হতে পারে। লালচে ঝুঁটি ও সোনালি পালকবিশিষ্ট এই জাতের মুরগি অন্যান্য দেশি মুরগির মতোই ১৬ সপ্তাহ বয়স থেকে ডিম দেওয়া শুরু করে। অনেকেই এই মুরগিকে পাকিস্তানী মুরগি হিসেবে জানেন ও চিনেন। কিন্তু দুংখের বিষয়, যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সোনালী মুরগির উদ্ভাবন করা হয়েছিল সেই সোনালী দিন আজ যেন ধূসর হতে চলছে। এর জন্য দায়ী একমাত্র অপরিকল্পতি ক্রসিং বা ব্রিডিং।  

সোনালি মুরগি সংকর (ক্রস) জাতের উদ্ভাবনের প্রেক্ষাপট ও ইতিহাসঃ
মূলত বহুল জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা মেটাতে গিয়েই আমাদের দেশের আবহাওয়া উপযোগী মুরগির জাত উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে সোনালি মুরগি উদ্ভাবন করা হয়। দেশী মুরগির ডিম ও মাংস উৎপাদন ক্ষমতা সীমিত। এরা সাধারণত বছরে ৫০-৬০ টি ডিম দিয়ে থাকে। সুতরাং দেশি মুরগির সাথে সামঞ্জস্যতা রক্ষা করে উন্নত জাতের ডিমের মুরগি তৈরি করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমেরিকান জাত আর.আই.আর (Rhode Island Red, RIR) ও  মিশরীয় ফাউমি  (Fayoumi) জাতের মুরগির ক্রসে সোনালি মুরগি উদ্ভাবন করা হয়। এজন্য সোনালিকে ক্রসব্রিড (সংকর জাত) মুরগি বলা হয়। সোনালির প্যারেন্ট নির্বাচনে, এই দুই জাতের মুরগির উন্নত লাইনের মাধ্যমে তৈরী করা হয়েছে। বানিজ্যিকভাবে, মাংসের জন্য সাধারনভাবে RIR-এর মোরগ ও ফাউমি জাতের মুরগি ব্যবহার করা হয়। আর ডিমের জন্য এর বিপরীত অর্থাৎ ফাউমির মোরগ ও RIR-এর মুরগি নেয়া হয়।


সর্বপ্রথম ১৯৮৭ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জনাব আব্দুল জলিল স্যার সোনালী জাতের মুরগী উদ্ভাবন করেছিলেন। পরবর্তিতে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জনাব ডাঃ শাহ জামাল স্যারের তত্ত্বাবধানে জাতটির উন্নয়ন করানো হয়। ১৯৯২ থেকে ২০০১-এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দাতা সংস্থা বিশেষ করে Smallholder Livestock Development Project (SLDP) and the Participatory Livestock Development Project (PLDP) বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে, যার মধ্যে প্রায় ১ মিলিয়ন মহিলা সুবিধাভোগী জড়িত। এই প্রকল্পগুলো সোনালী মুরগি পালনের উপর জোর দেয় এবং গ্রামীণ এলাকার অন্যান্য ক্ষুদ্র খামারিদের পোল্ট্রি খাতে জড়িত হতে উৎসাহিত করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলায় সোনালি মুরগির বিকাশ ঘটে। এরপর দ্রুতই এর আশে পাশের জেলা সমূহ ও পরবর্তিতে সারা বাংলাদেশেই এটি ছড়িয়ে পড়ে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, মাংস ও ডিমের স্বাদের কারনে সোনালি মুরগি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জিআই স্বত্বের জন্য সোনালি মুরগিকে নির্বাচিত করেন।  

হাইব্রিড সোনালি মুরগিঃ
বানিজ্যিকভাবে সোনালি মুরগি প্রধানত মাংস উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়। ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের সোনালি মুরগির বাজারে বেশ চাহিদা রয়েছে। সোনালির মাংস দেশী মুরগির মাংসের ন্যায় শক্ত ও সুস্বাদু এবং দেশি মুরগির ন্যায় ডিমের স্বাদ ও চাহিদার কারনে ভালো বাজার দর থাকায় বর্তমানে সোনালি মুরগি পালন বানিজ্যিকভাবে বেশ লাভজনক। সাধারণত সোনালি মুরগি ৬০ দিনে ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজন হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে সেই ওজন পাওয়া যাচ্ছেনা। সময়ের বিবর্তনে এবং খামারি ও লোকাল ব্রিডারদের অপরিকল্পিত প্রজননের কারণে বর্তমানে সোনালী মুরগিতে আর আগের মত ওজন বাড়ছে না। যেহেতু আগের মত ওজন বাড়ছে না তাই অধিকাংশ খামারি ও লোকাল ব্রিডার অধিক মাংস উৎপাদনশীল জাতের মুরগির সাথে সোনালী মুরগির ক্রস করাচ্ছে। এভাবে স্যাসো মুরগি, টাইগার মুরগি, সিপিএফ ৩ জাতের মুরগির সাথে সোনালী মুরগির সংকরায়ন বা ক্রসিং বা ব্রিডিং করিয়ে যে বাচ্চা উৎপাদন করছে সেটাই হচ্ছে হাইব্রিড সোনালি মুরগি। এছাড়াও খামারি ও লোকাল ব্রিডাররা একবার সোনালি মুরগির বাচ্চা নিয়ে সেগুলোকে বড় করে আবার সেই ব্যাচের মুরগিদের মধ্যে ব্রিডিং করে বাচ্চা উৎপাদন করছে। প্রজননের ভাষায় এটাকেই ইনব্রিডিং বা আন্তঃপ্রজনন বলে। এভাবে উদ্ভাবিত সোনালি মুরগিকে অনেক সময় কালার বার্ডও বলা হয়।

হাইব্রিড সোনালি মুরগি উদ্ভাবনের প্রধান কারণ সমূহঃ
মূলত হাইব্রীড সোনালি মুরগি এবং ক্ল্যাসিক (নরমাল) সোনালি মুরগি বাইরে থেকে দেখতে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সাধারণত ৬০ দিনের হিসাব করে হাইব্রিড মুরগি পালন করা হয়। এটা সত্য যে, যখন যে পণ্য চাহিদা মত পাওয়া যায়না, তখন তার চাহিদা মেটানোর জন্য তৈরী করা হয় হাইব্রিড। সুতরাং তেমনি ভাবেই হাইব্রিড সোনালি মুরগি উদ্ভাবনের প্রধান কারণ সমূহ হল-

হাইব্রিড সোনালি মুরগির বৈশিষ্ট্যঃ

হাইব্রিড সোনালি মুরগির তৈরির কুফল সমুহঃ

বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত যে, হাইব্রিড সোনালি মুরগির মাংসের স্বাদ বিশুদ্ধ সোনালি মুরগির থেকে অনেক কম। এধরনের মাংস ব্রয়লার মাংসের মত দ্রুত সিদ্ধ হয়। এছাড়া ও এই সোনালী মুরগির সাথে অনেক সময় দেশি মুরগির ব্রিডিং বা ক্রস হচ্ছে। এতে করে আমাদের অতি মূল্যবান একটি জেনেটিক সম্পদ বিশুদ্ধতা হারাচ্ছে এবং হুমকির মুখে পড়ছে। সাধারণ ক্রেতাগণ ও দেশি মুরগির প্রতি আস্থা হারাচ্ছে।

করণীয়ঃ
সম্ভবনাময় এই লাভজনক শিল্পকে সামনে হয়ত এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। সুতরাং, উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা যায়-এখনই সময় একটি সুনির্দিষ্ট বাস্তবধর্মী ও প্রয়োগিক নীতিমালা চালু করা।

বিবেচ্য করণীয় সমূহ-

উপসংহারঃ সাধারণ মানুষের মাঝে দেশি মুরগির মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে অথচ দেশি মুরগি বিলুপ্ত প্রায়। দেশি মুরগির মাংসের চাহিদা মেটাতে বিগত কয়েক বছরে সোনালী মুরগির প্রতি ভোক্তাদের আগ্রহ বেড়েছে। এ কারণে খামারী পর্যায়ে সোনালী মুরগির একদিনের বাচ্চার অতিরিক্ত চাহিদা রয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে হাইব্রিড সোনালী মুরগিতে বাজার সয়লাব হচ্ছে। তাই এটি বড়ই চিন্তার বিষয় যে, এসব অপরিকল্পিত ও ক্ষতিকর ইনব্রিডিং হতে হতে হাইব্রিড সোনালী মুরগির ও উৎপাদনশীলতা বিশুদ্ধ বা ক্ল্যাসিক সোনালী মুরগির মত কমে আসতে থাকবে। এভাবে হয়ত সোনালী মুরগির জাত এক সময় হারিয়ে যাবে। সেই দিন আসার আগে আমাদের সবারই সচেতন হওয়া উচিৎ।

লেখকঃ প্রফেসর, গবেষক, কন্সাল্ট্যান্ট
ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,রাজশাহী-৬২০৫, ইমেইলঃ This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.