প্রাকৃতিক খাদ্যশস্যের ‘এক পাওয়ার হাউস’ চিয়া বীজ: পুষ্টি ও শক্তির যোগানদাতা

মো: হাফিজুর রহমান:চিয়া নামের শস্যদানার ক্ষেত্রে Size doesn’t matter- এ কথাটি অক্ষরে অক্ষরে খাটে। ক্ষুদ্র দানাকৃতির এই বীজ আসলেই-এক পাওয়ার হাউস; পুষ্টি ও শক্তির উৎস। চিয়া অর্থ শক্তি! ইতিহাস থেকে জানা যায়, মেক্সিকোর অ্যাজটেক এবং মধ্য আমেরিকার মায়ান সভ্যতা পৃথিবীর পুরাতন সভ্যতা গুলোর মধ্যে অন্যতম। যীশু খৃষ্টের জন্মের প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে দক্ষিন আমেরিকায় এই সভ্যতার হদিস পাওয়া যায়। এই সময় থেকেই তারা দানাদার এক শস্যকে ‘ঈশ্বরের আশীর্বাদ- হিসেবে গুরুত্ব দিত! এই দানা শস্যের নামই ‘চিয়া (চিয়া অর্থ শক্তি!)। এক যাদুকরী দানা!

অ্যাজটেকদের মুল খাবার ছিল এই চিয়া বীজ। এমনকি তাদের প্রার্থনা/ উৎসর্গেও এই বীজের ব্যবহার হত। খৃষ্টপূর্ব ৩৫০০ বছর আগে থেকে এই বীজের ব্যবহার এর উল্লেখ পাওয়া গেছে । খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৯০০ সালের মধ্যে মেক্সিকোর টিওতিহুয়াকান ও টোলটেক জাতির লোকেরা এর চাষ করত। স্প্যানিশ দখলদার এবং পরে আমেরিকান আগ্রাসনে এই সভ্যতার ‘অবশেষটুকু ও প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, ১৫২১ সাল ও তার পরে!

চিয়া বীজ থেকে আটা তৈরি করে খেতো সাধারন মানুষ-কিন্তু অ্যাজটেক যোদ্ধারা এই দানা সরাসরি ব্যবহার করত- পরিবহন, রক্ষনাবেক্ষন ও ব্যবহারের সুবিধার্থে। পানিতে ভেজালেই এই বীজ ফুলে উঠে পানিটাকে ঘন ‘জেলী’ বানিয়ে ফেলে; সহজে খেয়ে নেয়া যায়! প্রাচীন যোদ্ধারা তাদের পুষ্টি ও শক্তির জন্য এই শস্যদানার উপরে নির্ভরশীল ছিল। কে না জানে সৈনিকদের শক্তির উপরেই যুদ্ধের জয় পরাজয় নির্ভর করে! আজকের দিনেও মেক্সিকোতে ‘তারাহুমারা উপজাতি তাদের দৌড়বিদদের নৈপুণ্যের জন্য বিখ্যাত! দুরপাল্লার দৌড়ে স্ট্যামিনা মূল বিষয়! এখনো মেক্সিকোর এই উপজাতির লোকেরা বিশেষ করে তাদের দৌড়বিদরা এই বীজ আর লেবু মেশানো শরবৎ খেয়ে নেয় এরপর তারা নাকি শত মাইল দৌড়াতে সক্ষম! শিকার আর দৌড়ের জন্য তাদের স্ট্যামিনা আসে এখান থেকেই এমন বিশ্বাস রয়েছে! (শক্তির উৎস এই chia মেশানো শরবৎ এর নাম Istiake!)।

দখলদার স্প্যানিশ দুর্বৃত্তরা (ইংরেজি বা স্প্যানিশে এদেরকে ‘এক্সপ্লোরার বা অভিযাত্রী বলা হলেও, এরা মূলতঃ দুর্বৃত্ত, দখলদার, পরাস্ব-অপহরণকারী- এর বেশী কিছু নয়) অ্যাজটেক যোদ্ধাদের ‘শক্তির উৎস ধ্বংস করতে, আইন করে এই- চিয়া দানার চাষবাস নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। এর বদলে গম যবের মত বিদেশী দানা শস্য চাষের আদেশ দিয়েছিল। চিয়া অ্যাজটেকদের জন্য শুধু শক্তির উৎস নয়, এর চাইতেও বেশী কিছু ছিল! তাই দখলদার শক্তির জন্য অ্যাজটেকদের মনোবল ভেঙ্গে ফেলতে চিয়া বীজ নিষিদ্ধ করেছিল। এমন ‘কৌশল শয়তান দখলদার শক্তিদের জন্য খুব স্বাভাবিক। আমাদের দেশেও মসলিন উৎপাদন বন্ধে এমন ‘আইন করা হয়েছিল-যা শুধু মসলিন নয়, বাংলার তাঁতি ও বস্ত্র শিল্প উভয়ই ধ্বংস করেছে- এর ফলে বাংলা মুলুক ব্রিটিশ বস্ত্রশিল্পের উপর পুরো নির্ভরশীল হয়ে পড়ে! বাংলাদেশকে পরনির্ভরশীল করতে এ চক্রান্ত মূলক ‘আইন এর ভুমিকা এখন আর কারো অজানা নেই। মেক্সিকান আদিবাসীদের ভুট্টা, শিম, আমার্যান্থ খুব গুরুত্ব পেয়েছে; আমাদের আধুনিক সভ্যতায় অতি গুরুত্ববহ মরিচ, স্কোয়াশ, এভোকাডো- এর উৎসও এই মধ্য আমেরিকান সভ্যতায়। স্প্যানিশদের আইন ‘প্রতিরোধ করে এই দানাদার শস্যটি দুয়েকটা এলাকায় কোনক্রমে টিকে গেছে এবং অল্পদিন আগে এর ‘গুণাবলী কেবল ‘সভ্য মানুষের নজরে এসেছে। এর উৎস হচ্ছে এক বর্ষজীবি মরুজ উদ্ভিদ- নাম Salvia hispanica এটি পুদিনা পরিবারের সদস্য।

Chia- অর্থ ‘শক্তি তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। লোককথা অনুসারে এই আদিম সভ্যতার মানুষগুলো চিয়ার সাদা ও কাল দানাগুলোকে শক্তির উৎস’ হিসেবে ব্যবহার করত! এতদিনে এর সত্যতাও প্রমানিত হয়েছে কারন এখন আমরা জানি এই ক্ষুদ্র বীজে রয়েছে উচ্চ মাত্রার পুষ্টিগুন সম্পন্ন ১৫-২০% প্রোটিন, ১৮-৩০% চর্বি, ৪১% ডায়েটারি ফাইবার/আঁশ, ১৮-৩০% অ্যাশ, ৪-৫ এন্টি অক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও খনিজ উপাদান! চিয়া বীজের বিশেষত্ব হল এর পুষ্টিমান। প্রক্রিয়াজাত না হয়েও সরাসরি শরীরে তা শোষিত হতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রাম চিয়া বীজে ৬৩১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৪০৭ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ৩৩৫ মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়াম, ৮৬০ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ৫৫.২ মাইক্রোগ্রাম সেলেনিয়াম, ৭.৭২ মাইক্রোগ্রাম আয়রন, ২.৭২ মাইক্রোগ্রাম ম্যাঙ্গানিজ ও ১৮ গ্রাম ওমেগা-৩-ফ্যাটি এসিড। এই এসিড শরীরের ট্রাইগিস্নসারিন বাড়ায় এবং কোলেস্টরল কমায়।

চিয়া সীডের পুষ্টিগুণ তুলনা করলে জানা যায় এর শক্তিমাত্রা কেমন? এতে রয়েছে দুধের চেয়ে ৫ গুণ বেশী ক্যালসিয়াম, কমলার চেয়ে ৭ গুণ বেশি ভিটামিন সি, পালং শাকের চেয়ে ৩ গুণ বেশী আয়রন (লোহা), কলার চেয়ে দ্বিগুণ পটাশিয়াম, স্যামন মাছের থেকে ৮ গুণ বেশী ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। বিভিন্ন ফল ও সবজির তুলনায় চিয়া বীজে বেশি ফাইবার থাকায় কোষ্ঠ্যকাঠিন্য নিরাময়ে খুবই উপযোগী। পেটের রোগ, হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোসহ ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এটি নিয়মিত সেবনে ওজন কমায়। প্রচুর এন্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে চিয়া বীজে। দুই বছর পর্যন্ত ফ্রিজে না রাখলেও খোলা বাতাসে এই বীজ ভাল থাকে! আর এর এন্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের ফ্রি রেডিক্যালস বার্ধক্য আর ক্যান্সার এর বিরুদ্ধে অতি কার্যকর এক অস্ত্র।  চিয়া বীজের পুষ্টিগুণ দানাদার শস্য বা তেলবীজ গুলোর মধ্যে সেরা।  ডি এন এ সংশ্লেষণ এবং বিপাকের প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি পূরনে এই চিয়া বীজ আমাদের ডায়েটে এক দারুন সংযোজন হতে পারে!

সাধারণত পুষ্টিকর সুস্বাদু খাদ্য গ্রহণের পরে আমাদের মনে এক ধরনের পরিতৃপ্তি আর সন্তুষ্টি আসে। এমন তৃপ্তিদায়ী এক ভোজনের পর মাঝখানে বার বার খাওয়ার ইচ্ছা জাগে না; প্রোটিন, ফাইবার আর জেলীর মত উপাদানের কারনে তরলের সাথে মিশে চিয়া মানসিক পরিতৃপ্তির কারন হয়; এটা শারীরিক পুষ্টি ও মানসিক প্রশান্তির যোগান দেয়। এছাড়া গ্লুটিন মুক্ত হওয়ায় যাদের শরীরে গ্লুটিন হজম হয় না, তাদের জন্য চিয়া বীজ এক আশীর্বাদ ।

তিষিতেও পর্যাপ্ত ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড রয়েছে; তবে এই উপাদান গুলো পেতে তিষির মত চিয়া বীজকে গুঁড়া করতে হয় না। এক ব্রিটিশ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে চিয়া বীজ কলস্টেরল আর ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে। এটা এইচডিএল বা ‘ভাল কলেস্টেরল এর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। সে হিসেবে কলস্টেরল এর রোগীদের জন্য চিয়া বীজ ভাল পথ্য হতে পারে। রক্তে ইনসুলিন এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রনে চিয়া বীজ ভাল ভূমিকা রাখে। রক্তে ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে এবং অস্বাভাবিক ইনসুলিনের পরিমাণ হ্রাস করে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রনে চিয়া বীজ ভূমিকা রাখতে পারে। এই দানা অন্যান্য খাদ্যের বা পানীয়র সাথে সহজেই মিশিয়ে নিয়ে খাওয়া যায়! চিয়া পুডিং বেশ বাজার পেয়েছে! সিরিয়াল, সস, সব্জি, এমনকি ইউগার্ট এর উপরে ছিটিয়ে দিয়ে খাওয়া যায়। চিয়া সিড সরাসরি যে কোন ফলের জুসের সাথে পান করা যায়। খৈ এর মত ভেজেও খাওয়া যায়! চিয়া বীজের নিরপেক্ষ স্বাদের কারণে এটা সব ধরনের খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়ার উপযুক্ত। তবে সবচেয়ে সহজ হল ষ্টীম করে নিয়ে সালাদ এর সাথে যোগ করা। বেক করা খাবার (বিস্কুট, কেক ইত্যাদি), সুপ, সালাদ ইত্যাদির সাথে মিশিয়েও চিয়া সীড খাওয়া যায়। যেভাবে ইসপগুলের ভুসি পানিতে ভিজিয়ে খেতে হয়, সেইভাবে পানিতে ভিজিয়ে রাখলে এক ধরনের জেলি বের হয়। এই জেলিই খেতে হয়। এ ছাড়া রুটি, পুডিং, কেক, পাউরুটির সঙ্গে মিক্সিং করে খাওয়া যায়। ফুটন্ত গরম পানিতে চিয়া পাতা ৩-৫ মিনিট রেখে দিলে হলুদ রংয়ের আকর্ষণীয় চা  তৈরী করে পান করা যায় । এছাড়াও পেট্রিডিশ বা প্লাস্টিক পটে চিয়া বীজ থেকে ১০-২১ দিন বয়সের মাইক্রোগ্রীন বা কচি চারা তৈরী করে সালাদ বানিয়ে পিজ্জা ও বার্গারের সাথে খাওয়া যায়।



ওজন নিয়ন্ত্রনে চিয়া বীজ:
এই শস্য দানাকে ওজন কমাতে সহায়ক মনে করা হয়! সত্যিই এটা তেমন কাজের কিনা তা পরের কথা তবে বাজারজাতকারীদের প্রচারনা কৌশলে এর মূল্য এখন গগনচুম্বী হয়ে গেছে! ১০০ গ্রামের এক প্যাকেট চিয়া বীজ বিক্রয় হচ্ছে ২-৩ ডলারে; তার অর্থ প্রতি কেজি ২০- ৩০ ডলার! (আর কোন দানা শস্য এত দামে বিক্রি হয় বলে আমার জানা নেই)। সত্যি কি এটা ওজন কমায়? এর পেছনে সত্যতা কতটুকু তা তলিয়ে দেখার প্রয়োজন হয়নি। তাত্বিকভাবে, এটা মানুষের পেটে ঢুকলে তা ফুলে উঠার কথা এবং ‘পেটভর্তি হয়ে গেছে এমন অনুভূতি জন্ম দেয়ার কথা। তাহলে মানুষ কম খাবে। অ্যাজটেকরা বেশ লম্বা ও স্লিম এবং শক্তিশালী ছিল; তারা দীর্ঘ সময় কর্মক্ষম থাকত। প্রচারনায় এমন ধারনা আরও জোরদার হয়েছে। এই বীজ খেলেই এমনটা হওয়া সম্ভব! আমরা ভাবছি না। চাকার ব্যবহার জানত না অ্যাজটেকরা, শত শত মাইল তারা হেঁটে বা দৌড়ে অতিক্রম করত। এমন কায়িক শ্রমে অতি ‘মোটা একজন মানুষও ‘স্লিম হয়ে যাবে কোন সন্দেহ নেই। শক্তি ও পুষ্টি সরবরাহ করে যে শস্য দানা তা মানুষকে ওজন কমিয়ে ‘স্লিম করবে কিভাবে? যদি এর কোন স্পেশাল ক্ষমতা থাকে তা গবেষণা করে প্রমান করা দরকার! বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা জানা দরকার।
 
১২ সপ্তাহের এক ট্রায়ালে প্রতি দিন ৫০ গ্রাম চিয়া বীজ খাইয়ে দেখা গেছে ওজন হ্রাস বা ক্ষুধা কমার তেমন তারতম্য ধরা পড়েনি! নর্থ ক্যারোলাইনার আপ্পালেসিয়ান ইউনিভার্সিটির ডঃ ডেভিড নিউম্যান জানিয়েছেন! "Our study showed no reduction in body weight, body fat and no improvement in traditional cardiovascular markers from 50 grams of chia per day.” তিনি জানিয়েছেন  

"Use chia seeds in foods, not as a supplement, but as an alternative to processed grains like white bread because it is a much healthier whole grain that is great-tasting in foods like muffins," ডাঃ মেহমেত অজ আমেরিকার এক সেলিব্রেটি হার্ট সার্জন লিখেছেন।

ডাঃ অজ এবং সহকর্মী ডাঃ রয়জেন এর লেখা এই বইতে তারা পরামর্শ দিয়েছেন- প্রতিদিন দুইবার ২০ গ্রাম করে খাওয়ার একটা ‘ডোজ। তারা অবশ্য মনে করিয়ে দিয়েছেন এই শস্য দানায় এন্টিঅক্সিডেন্ট এর পরিমাণ খুব উঁচুমাত্রার এমনকি ব্লু বেরির থেকেও বেশি।

হৃৎপিন্ডের স্বাস্থ্য আর শরীরের ওজনের উপরে চিয়া’র প্রভাব নিয়ে দুটো মাত্র ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে । হার্ট এর কিছু উপকার নিশ্চিত হয় দেখা গেলেও ওজন কমার বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি; বলেছেন এক গবেষক Catherine Ulbricht, PharmD। স্থির সিদ্ধান্তে আসতে হলে আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন, বলেছেন মিস উলব্রিখট। আমাদের দেশের চিনা (Panicum millaceum) বা কাউন বীজ (Setaria italica) এর সাথে এর সাদৃশ্য রয়েছে, এদের পুষ্টিমাত্রা নিয়ে চিয়া বীজের সাথে তুলনামূলক গবেষণা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই যদিও।

চিয়ার উদ্ভিদতাত্ত্বিক পরিচিতি ও চাষবাসঃ
Chia (Salvia hispanica), মিন্ট পরিবার বা Lamiaceae র সদস্য। মেক্সিকো গুয়াতেমালার আদি অধিবাসী হলেও, এর বর্তমান চাহিদা বৃদ্ধির কারনে এখন অনেক দেশেই বানিজ্যিক ভাবে এর চাষ হচ্ছে। আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, বলিভিয়া, পেরু, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। চিয়া বর্ষজীবী, ওষধি তৈলবীজ- তিল বা তিষির মত। এক মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতা প্রতিপন্ন, দন্তর। ফুল স্পাইকে সজ্জিত, নীল, বেগুনী বা সাদা রং এর হতে পারে। দুটো বর্ধিত ঠোঁটের মত ফুল যা মিন্ট পরিবারের বৈশিষ্ট! উচ্চ মাত্রায় স্ব-পরাগী। গোল বা উপবৃত্তাকার বাদামি থেকে ধূসর সাদা বা ধূসর-সাদা রঙের বীজ হয়! পানিতে ভিজিয়ে রাখলে পানি জমে যায়- অনেকটা ইসবগুলা ভুষির মত, তবে এই ভুষি হল প্রক্রিয়াজাত, আর চিয়া বীজ এই কাজ করে সরাসরি- এটাই পার্থক্য।

স্প্যানিশদের প্রতিবন্ধকতার আইনের কারনে এটা অন্ধকারে ছিল দীর্ঘদিন, তারা চিয়ার বদলে গম যব এর চাষকে উৎসাহিত করেছে এখানে। ৮০'র দশকে কেবল আমেরিকান গবেষণায় এটা আমাদের নজরে এসেছে। ‘ওয়েন কোটস’ নামের এক এগ্রি ইঞ্জিনিয়ার নব্বই এর দশকে এর প্রচারনা শুরু করেন; এবং এরপরেই চিয়া, দানা শস্য ও হেলথ ফূড হিসেবে প্রথমে আমেরিকায় এবং সে সাথে সার দুনিয়ায় ‘গ্রহণযোগ্যতা পায়।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে পুষ্টিমানের দিক থেকে চিয়া বীজ হল- প্রকৃতিতে অধিক মাত্রার আলফা লিনোলিনিক এসিড বা ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিডের উদ্ভিজ্জ জাত উৎস হিসেবে অন্যতম!

Salvia hispanica মরুজ উদ্ভিদ জন্য খুব কম পানি সরবরাহে চিয়া বীজের চাষ করা যায়। বাংলাদেশে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে ‘পানি শুন্যতা দেখা দিচ্ছে যে অঞ্চল গুলোতে সেখানে পরীক্ষামূলক ভাবে এর চাষ করা যেতে পারে দেশের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ভেবে দেখতে পারেন। এখনকার বাজারে এত দামের ফসল হিসেবে চিয়া বীজ কৃষকদেরকেও আর্থিকভাবে লাভবান করবে, সন্দেহ নেই।

চিয়া বীজের প্রকারভেদ:প্রধানত দুটি ভিন্ন ধরণের চিয়া বীজ রয়েছে একটি কালো চিয়া বীজ এবং অন্যটি সাদা রঙের বীজ। বেগুনি ফুল উৎপাদনকারী চিয়া গাছগুলি বাদামী বীজ দেয়। এই বাদামী রঙের বীজগুলিকে "কালো চিয়া" বলা হয়। সাদা ফুল উৎপন্নকারী চিয়া উদ্ভিদ কেবল সাদা বীজ উৎপন্ন করে। সাদা চিয়া বীজ হল সাদা, ধূসর এবং হলুদ মার্বেলযুক্ত রঙের মিশ্রণ বীজ।


চিয়া বীজের বংশ বিস্তার:চিয়া বীজ বীজ এবং চারা উভয় থেকে বংশ বিস্তার করা হয়, বীজ থেকে চিয়া উদ্ভিদ বৃদ্ধি করা সবচেয়ে ভাল। চিয়া বীজ ৫-৭ দিনের মধ্যে অঙ্কুরিত হতে শুরু করে।

চিয়া বীজ চাষের জন্য তাপমাত্রা এবং জলবায়ু:চিয়া বীজ ফসলের বৃদ্ধির জন্য সর্বনিম্ন ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বাধিক ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস  তাপমাত্রা এবং অনুকূল তাপমাত্রা ১৬-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস প্রয়োজন।  চিয়া বীজ ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উষ্ণ তাপমাত্রায় ভাল জন্মে। চিয়া বীজ ফসলের জীবন চক্রের সময়কাল অবস্থানের উপর নির্ভর করে এবং বৃদ্ধি  উচ্চতা / অক্ষাংশ দ্বারা প্রভাবিত হয়। অনেক সবজি বীজের মতো চিয়া উদ্ভিদ হল স্বল্প দিনের ফুল গাছ যা ১২-১৩ ফটোপেরিওডিক থ্রেশহোল্ডে তার বৃদ্ধি এবং ফলের সময়কাল  অক্ষাংশ/উচ্চতার বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে। উত্তর গোলার্ধে চিয়া অক্টোবরে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে এপ্রিল মাসে ফুল আসতে শুরু করে। বিভিন্ন বাস্তুসংস্থানে চিয়া বীজের জীবন চক্রের সময়কাল ১০০-১৫০ দিনের মধ্যে। চিয়া উদ্ভিদ স্বল্প দিনের ফুল গাছ হওয়ায় এটি ফটোপেরিওডিক সংবেদনশীলতা এবং ফটোপারিওডিক পরিবর্তনশীলতার অভাব নির্দেশ করে, যা  ক্রান্তীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় অক্ষাংশে সীমিত আকারে বাণিজ্যিক চাষে উৎসাহিত করে।

বাংলাদেশে চিয়া বীজ চাষের জন্য উপযুক্ত মৌসুম
দেশীয় আবহাওয়ায় চিয়া বীজ রবিশস্য হিসেবে চাষ করা যায়। শীত হল চিয়া বীজ রোপণ ও বৃদ্ধির আদর্শ সময় কারণ এটি একটি স্বল্প দিনের ফুল গাছ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় দীর্ঘ দিনের ঋতুতে বৃদ্ধি পায় না। বেশি ফলনের জন্য ১৫ই নভেম্বরের মধ্যে চাষ করতে হবে। তবে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ এবং জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহেও বোনা যেতে পারে। ফসল ঘরে উঠাতে ৯০-১০০দিন সময় লাগে।
 
চিয়া বীজ চাষের জন্য মাটি:ফসলটি সব রকম মাটিতে চাষ করা যায়। হালকা থেকে মাঝারি কাদামাটি বা বেলে থেকে বেলে দোআঁশ মাটি প্রয়োজন। ভালভাবে নিষ্কাশিত, মাঝারি উর্বর মাটিতে ভাল ফলন দিতে পারে। এটি অ্যাসিড মাটি এবং মাঝারি খরাও প্রতিরোধ করতে পারে। চিয়া বীজ বপন ও চারা স্থাপনের জন্য সম্পূর্ণ আর্দ্র মাটির প্রয়োজন কিন্তু পরিপক্ক চিয়া উদ্ভিদ বৃদ্ধির সময় ভেজা মাটি প্রতিরোধ করতে পারে না।

বীজের হার: সাধারণত বিঘা প্রতি ১০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।

চিয়া বীজ বপন ও চারা রোপন পদ্ধতি:৩/৪টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুড়া করে জমি প্রস্তুত করে নিতে হবে। মাটি আগাছামুক্ত হওয়া উচিত। চিয়া বীজ খুবই ক্ষুদ্র বীজ। তাই সরাসরি বীজ ছিটিয়ে বপন করার আগে প্রায় পাঁচ কেজি শুকনো বালি বা ছাই বীজের সাথে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর সরিষা/তিল এবং আমরান্থ শাক বীজের মত ৪০-৫০ সেন্টিমিটার সারি থেকে সারিতে বালু বা ছাই মাখা বীজ ক্রমাগত ছিটাতে হবে। এছাড়া চারা করে ১৫-২৫ দিন বয়সের চারা ৪০-৫০ সেন্টিমিটার সারি থেকে সারিতে এবং গাছ থেকে গাছ ২০ সেন্টিমিটার দূরত্বে ভিজা মাটিতে লাগানো যায়।

আন্তঃপরিচর্যা:

সার ও সেচ:চিয়া বীজ কম সার প্রয়োগের মাধ্যমে চাষ করা যেতে পারে। সুপারিশকৃত সার বিঘা প্রতি ইউরিয়া ৩০ কেজি, ট্রিপল সুপার ফসফেট ৪৫ কেজি, মিউরেট অফ পটাশ ২০ কেজি এবং বোরিক এসিড ৩০০ গ্রাম। চূড়ান্ত জমি প্রস্তুতির সময় শেষ চাষে আনুমানিক এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া এবং সম্পূর্ণ পরিমাণ অন্যান্য সার প্রয়োগ করতে হবে। পরবর্তীতে দুই-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া দুটি কিস্তিতে ২০ DAE (Days After Emergence) এবং ৪০ DAE তে প্রয়োগ করতে হবে। চিয়া গাছ রোদ, ভেজা-নিষ্কাশন এবং খরা পছন্দ করে কিন্তু নিয়মিতভাবে পানি দিলে এর বাড়বাড়ন্ত বৃদ্ধি পায়। তাই ভাল ফলনের জন্য আবহাওয়া এবং বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে দুই-তিনটি সেচের প্রয়োজন হতে পারে।

গাছ পাতলাকরন ও আগাছা পরিষ্কারকরন:গাছ গজানোর প্রায় ১০-১৫ দিন পর, গাছের সংখ্যা ঠিক রাখতে অতিরিক্ত চারা অপসারণ করতে হবে। পাতলা চারা মুরগির খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, অথবা পঁচিয়ে সার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, সেইসাথে চিয়া চা তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। আগাছা চিয়া ফসলের প্রাথমিক বৃদ্ধিতে পর্যায়কালে একটি বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে, সুতরাং চিয় ফসলের ক্ষেত্র ১৫-২০  DAE (Days After Emergence) সময় পর্যন্ত আগাছামুক্ত রাখা উচিত।

রোগ ও কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা:চিয়া ফসলে তেমন কোন কীটপতঙ্গ বা রোগবালাই এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। চিয়া পাতায় অপরিহার্য এমন কিছু তৈলাক্ত পদার্থ ও গন্ধ রয়েছে যা পোকামাকড়ের প্রতি আরও প্রতিরোধী করে তোলে, ফলে কীটনাশক ছাড়াই  নিরাপদ/জৈব চাষের জন্য উপযুক্ত। কখনও কখনও সাদা মাছি দ্বারা সালভিয়া বংশকে সংক্রামিতকারী ভাইরাস যেমন শসার মোজাইক ভাইরাস, ব্রড বিন উইল্ট ভাইরাস, মুগ ডাল হলুদ মোজাইক ভাইরাস, টমেটো হলুদ পাতা কার্ল ভাইরাস এবং অন্যান্য পুতেটিভ গোল্ডেন মোজাইক ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায় । ফসলে এই ভাইরাসে সংক্রমণ দেখার সাথে সাথে আক্রান্ত গাছ উঠিয়ে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে এবং সাদা মাছি নিয়ন্ত্রনের জন্য এডমায়ার ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১-২ বার স্প্রে করতে হবে।

ফসল সংগ্রহ: যখন ৬০-৮০% ফুলের মাথা বাদামী এবং হলুদ-ব্রাউন রঙে পরিণত হয়, তখন চিয়া ফসল কাটার জন্য প্রস্তুত হয়। মাটির উপরে থাকা পুরো চিয়া গাছগুলি কেটে নিয়ে ত্রিপল বা পরিষ্কার মেঝেতে রেখে রোদে শুকাতে হবে। এক-দুই দিনের রোদ শুকানোর পরে, বাঁশ বা কাঠের লাঠি দিয়ে আলতো ভাবে আঘাত করলে গাছ থেকে বীজ আলাদা হয়ে যাবে। তারপর বীজ ঝেড়ে পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করতে হবে। চাষের পদ্ধতি ও ভৌগলিক অঞ্চল ভেদে ফলন বিঘা প্রতি ১৫০ থেকে ২০০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হতে পারে।

লেখক পরিচিতি:বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, যশোর   
মোবাইল-০১৭৫৭-৮০২১৮৯
E-mail: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.