উপকূলীয় অঞ্চলে মুগডাল চাষ

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

ড. মোঃ সহিদুল ইসলাম খান: মুগ ডাল উপকূলীয় অঞ্চলের একটি সু পরিচিত ডাল ফসল। এ ডালের আবাদ প্রথমে বরিশাল ও ভোলা জেলায় সীমাবদ্ধ থাকলেও বিগত ১০-১৫ বছর যাবত পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার আমন কর্তন পরবর্তী পতিত জমিতে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। জমি, আবহাওয়া এবং নদ-নদীর জোয়ার-ভাটা ইত্যাদি বিচারে বারশাল-পটুয়াখালী অঞ্চল মুগ-ডাল চাষের জন্য উপযুক্ত। তাই প্রতি বছর মুগডাল চাষের আওতায় জমির পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে (চিত্র-১)।

বর্তমানে উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে পটুয়াখালীতে সব চেয়ে বেশী মূগডাল চাষ হয় (চিত্র-২)। দেশে উৎপাদিত মুগ-ডালের প্রায় ৬০% উৎপাদিত হয় উপকূলীয় অঞ্চলে। ডালের আমিষ বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠির নিকট পুষ্টি নিরাপত্তায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টির দিক থেকে ডালজাতীয় ফসলের মধ্যে মুগডাল (Vigna radiata L.) সেরা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শুষ্ক ওজনের ভিত্তিতে, মুগডালে ২২-২৮% আমিষ, প্রচুর খাদ্য আঁশ, খাদ্য কনিকা এবং নানারূপ মিভামিন সহ অপরিহার্য এমাইনো এসিড রয়েছে (Lambrides and Godwin, 2007)। শুটিজাতীয় অন্যান্য যে কোন ডালের তুলনায় মুগডালের আমিষ সহজপাচ্য। এছাড়াও রাইজোবিয়াম প্রজাতির সাথে সিমবায়োসিস প্রক্রিয়ায় বায়ুমন্ডলীয় নাইট্রোজেন (৫৮-১০৯ কেজি/হেক্টর) মাটিতে ফিক্স করে, যা শুধুমাত্র নিজস্ব নাইট্রোজেনের চাহিদা মেটায় না, বরং পরবর্তী ফসলের জন্যও উপকার করে (Ali and Gupta, 2012)। তাই এ ফসলের আবাদ অব্যাহত রাখা খুবই জরুরী।



উৎপাদন পদ্ধতি:বপন সময়: উপকূলীয় অঞ্চলে মুগডাল চাষ এর উপযুক্ত সময় রবি মৌসুমের শেষভাগ অর্থাৎ সম্পূর্ন মাঘ মাস (১৫ জানুয়ারী থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারী)। কারন এ সময়ে জমিতে রসের পরিমান কমে চাষ উপযোগী পর্যায়ে আসে, শীত পরবর্তী মাটি ও বাতাসের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে থাকে, দক্ষিনা অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার বাতাস এর প্রবাহ শুরু হয় যা গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে বাড়িয়ে দেয়। যে সব জমিতে হঠাৎ অমৌসুমি বৃষ্টিপাতের পানি জমে থাকার সম্ভাবনা নাই এবং মার্চ-এপ্রিল মাসে নদী-খালের স্বাভাবিক জোয়ারের পানি ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা নাই এমন জমিতে মুগডাল চাষ করতে হবে। আমন ধান কাটার পর জমি থেকে খড় সরিয়ে ফেলতে হবে। মাটি শুকিয়ে জো অবস্থায় আনতে হবে।  

বপন পদ্ধতি: ছিটিয়ে ও সারি উভয় পদ্ধতিতেই বীজ বপন করা যায় তবে সারি করে বপন করাই উত্তম। ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে ট্রাক্টরের মাধ্যমে একটি কিংবা টিলারের মাধ্যমে দুইটি চাষ দিয়ে প্রয়োজন হলে মাটির রস কমানোর জন্য ১/২ দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে জমিতে রস কম থাকলে অপেক্ষার প্রয়োজন হয় না। অতপর বিঘা প্রতি ৪ কেজি বীজ, প্রয়োজনীয় সার যেমন- বিঘা প্রতি ৫-৬ কেজি ইউরিয়া, ১০-১৩ কেজি টিএসপি, ৫-৬ কেজি এমওপি এবং ১-১.৫ কেজি বোরন সার ছিটিয়ে একটি চাষ ও মই দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে। সারিতে বপনের ক্ষেত্রে একটি নিদ্ধিষ্ট দূরত্বে বীজ বপন খুবই কষ্টসাধ্য। তাই সারিতে বীজ বপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট উদ্ভাবিত বীজ বপন যন্ত্র (বারি বীজ বপন যন্ত্র) ব্যবহার করা যেতে পারে।



বারি বীজ বপন যন্ত্রঃ বারি বীজ বপন যন্ত্রটি পাওয়ার টিলার চালিত। এটি পাওয়ার টিলারের পিছনে জুড়ে দিয়ে একই সময়ে জমি চাষ, বীজ বপন ও বীজ ঢেকে দেয়ার কাজ করা যায়। মুগের ক্ষেত্রে যন্ত্রটিতে ২০ খাঁজের ইনক্লাইন্ট প্লেট ব্যবহার  করে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি বা ১২ ইঞ্চি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৭ সেমি বা ৩ ইঞ্চি এবং সঠিক গভীরতায় (০৫ সেমি) চার সারিতে বীজ বপন করা যায়। যন্ত্রটি ব্যবহারে ছিটিয়ে বপনের চেয়ে ২৫-৩০ শতাংশ বীজ কম লাগে, ফলনও ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সারিবদ্ধভাবে বীজ বপনের ফলে আগাছা দমন, কীটনাশক প্রয়োগ ও ডাল তোলা ইত্যাদি কাজ করার জন্য ছিটিয়ে বপনের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ সময় ও খরচ কম লাগে। এ যন্ত্র দ্বারা এক দিনে প্রায় ০৪ (চার) বিঘা জমিতে মুগ বীজ বপন করা যায়। প্রথমে জমিতে প্রয়োজনীয় সার ছিটিয়ে যন্ত্রটি দিয়ে একই সময়ে জমি চাষ, বীজবপন ও বীজ ঢেকে দেয়ার কাজ করা হয়।

মুগের জাত: উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৯০ ভাগ জমিতে বারি মুগ-৬ এর চাষ হয়ে থাকে। এ জাতটি উপকূলীয় আবহাওয়ার সাথে অধিক মাত্রায় অভিযোজিত। বারি মুগ-৬ জাতের গাছের উচ্চতা ৪০-৪৫ সেমি। পাতা ও বীজের রং গাঢ় সবুজ এবং পাতা চওড়া। ফুল আসার পরে দৈহিক বৃদ্ধি কম। দানার আকার বড়। হলুদ মোজাইক ভাইরাস এবং পাতায় দাগ রোগ সহনশীল। জীবনকাল ৭০-৮০ দিন। একই সময়ে প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ ফল পরিপক্ক হয়। ফল পরিপক্ক হয়ে কালচে বর্ণ ধারণ করলে ফল সংগ্রহ উপযোগী হয়। ২-৩ বারে ফল সংগ্রহ করতে হয়। হেক্টর প্রতি ফলন ১৫০০-১৬০০ কেজি।



রোগ ব্যবস্থাপনা: মাঠে মুগ ডাল চাষাবাদের ক্ষেত্রে কৃষকগণ চারা থেকে ফসল সংগ্রহ পর্যায় পর্যন্ত বেশ কিছ রোগবালাই এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ এর সম্মুখীন হন। এগুলি পাতা, ফুলের কুঁড়ি, ফুল এবং বিকাশমান বা পরিপক্ক ফলের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করে। মুগডালের রোগের মধ্যে পাতার দাগ, পাউডারী মিলডিউ ও হলদে মোজাইক উল্লেখযোগ্য।

পোকা দমন: মুগডালের মাঠে বীজ গজানোর পর থেকে পর্যায়ক্রমে ফ্লি বিটল, পাতা মোড়ানো পোকা, জাব পোকা এবং ফুল ও ফল ধারণের সময় থ্রিপস পোকার আক্রমন হয়।

ফসল তোলা: উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকরা সাধারনতঃ পরিবারের বাহিরের গরীব মহিলা-শিশুদের দিয়ে সংগৃহীত মুগডালের একটি নির্দিষ্ট অংশ বিনিময়ের মাধ্যমে মূগডাল তোলার কাজ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে একই জমি থেকে ডাল তোলার জন্য ১ম বার শতকারা ৩০ ভাগ, দ্বিতীয় বার শতকারা ৪০ ভাগ এবং তৃতীয় বার শতকারা ৫০ ভাগ সংগৃহীত ফল বা পড মজুরী হিসাবে প্রদান করতে হয়। ফল বা পড সংগ্রহের পর তিন পর্যায়ে অর্থাৎ রোদে শুকানো, খোসা ছড়িয়ে মুগডাল বীজ বের করা এবং অন্তঃত দুই দিন রোদে শুকানোর পর গুদামজাত কিংবা বাজারজাত করা হয়।

বীজ সংরক্ষণ:
যেহেতু মুগডাল উপকূলীয় অঞ্চলের একটি অন্যতম প্রধান ফসল তাই উৎপাদন মৌসুমে প্রচুর পরিমান বীজের প্রয়োজন হয়। কৃষকরা নিজেরাই তাদের উৎপাদিত ভালো মানের বীজ পরবর্তী বছরের জন্য সংরক্ষন করতে পারেন। কৃষক পর্যায়ে ভালো মানের মুগডাল সংরক্ষনের জন্য বীজে আর্দ্রতার পরিমান ও পোকার অক্রমনের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। সংরক্ষণকালে বীজের আর্দ্রতা যদি ১২% এর বেশি থাকে তাহলে শুসরী পোকার দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটে এবং আক্রমনের মাত্রাও বেড়ে যায়। বীজের গায়ে সাদা সাদা ডিমের উপস্থিতি ও গোলাকার ছিদ্র দেখে এদের আক্রমণ শনাক্ত করা যায়। পরবর্তী বচরের জন্য বীজ সংরক্ষনের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাপনা কৌশল মেনে চলতে হবে।

ব্যবস্থাপনা কৌশল:

মুগডাল চাষে খরচ, আয় ও মুনাফা
মুগডাল একটি কম পূঁজি নির্ভর ফসল। মুগডাল উৎপাদনের জন্য জমি চাষ, বীজ বপন, বীজ, সার, বালাই দমন, ডাল সংগ্রহ, মাড়াই-ঝাড়াই ও বাজারজাত করন ইত্যাদি কাজে টাকা খরচ করতে হয়। খরচের বেশীর ভাগই হয়ে থাকে ফসল সংগ্রহের জন্য। মুগ ডাল সাধারনত এলাকার মহিলারাই ফলন ভাগাভাগীর মাধ্যমে সংগ্রহ করে থাকে। এজন্য মোট উৎপাদনের শতকরা ৩৭.৫ ভাগ সংগ্রহকারীদের দিয়ে দিতে হয়। তাই সংগ্রহ কাজে নগদ অর্থ ব্যয় করতে হয় না বিধায় এ খাতকে অনেকে খরচের হিসাবে ধরেন না। তবে সব খরচ বিবেচনায় নিয়ে এক হেক্টর জমিতে ১২০০ কেজি মুগডাল উৎপাদিত হলে প্রতি কেজি ৬৭ টাকা দরে বিক্রি করে প্রায় ২৬,৭৫০ টাকা আয় করা যায়।

লেখক:প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, পটুয়াখালী