পোল্ট্রি ও ফিস ফিড মোড়কীকরণে জুট ব্যাগের ব্যবহার: পোল্ট্রি ও ফিস ফিড ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যত ??

কৃষিবিদ মোঃ আক্তারুজ্জামান: এক সময় প্রচলিত কথা ছিল “দুধে মাছে বাঙ্গালী”-কথাটি আজও প্রচলিত, তবে এর সাথে যোগ হয়েছে মাংস ও ডিম। তাই তো আমরা আজ দুধ, মাছ, মাংস ও ডিমের বাঙ্গালী খাদ্যের ৬টি উপাদানের মধ্যে প্রোটিনের যোগান দাতা উপাদান হচ্ছে এই দুধ, মাছ, মাংস ও ডিম। এর মধ্যে পোল্ট্রি মিট/মাংস ও ডিমের যোগান দিচ্ছে সারাদেশে বিস্তৃত ব্রয়লার ও লেয়ার ফার্ম। প্রায় ২০,০০০ (বিশ হাজার) লেয়ার ফার্ম এবং প্রায় ৬০,০০০ (ষাট হাজার) ব্রয়লার ও সোনালী ফার্ম। এই ৬০,০০০ (ষাট হাজার) ফার্ম ব্রয়লার ও সোনালী মুরগি পালনের মাধমে পোল্ট্রি মিটের যোগান দিচ্ছে।

কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী সময়ে পোল্ট্রি ফার্মের সংখ্যা আরও বেশি ছিল। করোনার প্রভাবে সুষ্ঠু বিপনন ব্যবস্থার অভাব, খাদ্য তৈরীর উপাদান সমূহের উচ্চ মূল্য, রেডিফিডের দাম বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ও মাঝারী খামারীদের পুঁজি স্বল্পতা এই শিল্পের উন্নয়নে বিশেষ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭০-এর দশকের যে শিল্পের গোড়া পত্তন হয়েছিল এবং ৮০-এর দশকে যে শিল্পের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি এবং ৯০-এর দশকে শিল্পের সফলতা দেশকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সহজলভ্য প্রাণীজ আমিষের যোগান দিয়ে জিডিপিতে অবদান রাখছে, ১.৪৫ (২০২০-২০২১)। গ্রামীণ অর্থনীতিতে, জিডিপিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বিশেষ করে নারীর কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা সৃষ্টিতে যে শিল্পের এত অবদান সেই শিল্পের উন্নয়নে ও প্রসারে প্রতিটি স্টেক হোল্ডার অত্যন্ত সতর্ক ও মনোযোগী। বাচ্চার গুণগত মান, নতুন নতুন জাত উন্নয়ন (দেশীয় স্বাদের কাছাকাছি মুরগি) ফুড সেফটি, খাদ্যের গুণগত মান খাদ্য উৎপাদন কারখানায় ল্যাব বাধ্যতামূলক, পুষ্টিবিদদের দ্বারা খাদ্যের ফর্মূলা নিয়ন্ত্রন, প্রাণী চিকিৎসকের দ্বারা অযাচিত এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রন, ফার্মগুলোর প্রতিনিয়ত আধুনিকায়ন ও এসোসিয়েশন এবং প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর দ্বারা খামারের নিবন্ধনকরণ এই শিল্পকে নতুন উন্নয়নের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে।

বিশেষ করে খাদ্য তৈরীতে মানসম্পন্ন উপাদানে ব্যবহার এবং পুষ্টিমান প্রোটিন, শক্তি, ময়েশ্চার, খনিজ ভিটামিন ইত্যাদির সঠিক মান/পার্সেন্ট নিশ্চিত করণ এখন ফুড সেফটি ও প্রতিযোগিতা এবং এক্সপোর্ট বাজারে সবার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এদেশে খাদ্যের ময়েশ্চার/জলীয় অংশ নিয়ন্ত্রন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চলমান খাদ্যের ফর্মূলায় “মোল্ড ইনহিবিটর” যোগকরণ বাধ্যতামূলক হয়, কেননা খাদ্যে ময়েশ্চার/জলীয় অংশ ১২% এর অধিক হলে খাদ্যে ছত্রাক/ফাংগাস/মোল্ড তৈরী শুরু হয়। এই ফাংগাস থেকে বেশ কয়েকটি টক্সিন/বিষ তৈরী হয়। এই খাদ্যের মান সঠিক রাখার খাদ্যে “টক্সিন বাইন্ডার” ডোজ বাড়াতে হয়। এর পরেও এন্টি অক্সিডেন্ট খাদ্যে মিশাতে হয়, যাতে করে খাদ্যের ময়েশ্চর/জলীয় অংশ দ্বারা খাদ্য যেন দ্রুত পঁচন না হয়। এর পরেও খাদ্যের পিপি ওভেন ব্যাগের ভিতরটা লেমিনেটেড করা হয় এবং ভিতরে একটি পলিথিন ব্যাগের ভিতর খাদ্য রাখা হয়।

খাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করণ ও খাদ্যের পঁচন রোধ করার মাধ্যমে আজ খাদ্য রপ্তানী হচ্ছে। পিপি ওভেন ব্যাগে খাদ্যের পুষ্টিমান প্রিন্টকরণ ও খাদ্য মিলের ল্যাবে পুষ্টিমান পরীক্ষাকরণ ফুড সেফটি ও পোল্ট্রি উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জানা যায় অভ্যন্তরীণ বাজারে পাট পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ পাট খাতে সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে পাট আইন-২০১৭ এবং জাতীয় পাটনীতি-২০১৮ প্রণয়ন করে সরকার। প্লাস্টিক যেহেতু পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তাই পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিও প্রজ্ঞাপন জারীর সময় বিবেচনায় আনা হয়। আর পরিবেশের দিক বিবেচনা করে পোল্ট্রি ও ফিস ফিডের মোড়কে পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলক এবং প্লাস্টিকের বস্তার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সর্বমোট ১৯টি পণ্যের ক্ষেত্রে এই বাধ্য-বাধকতা দেয়া হয়। প্রথমে ১৭টি পণ্যের জন্য নির্দেশনা ছিল, সর্বশেষ ২টি পণ্য পোল্ট্রি ও ফিস ফিড সহ মোট ১৯টি পণ্যের জন্য নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের এসআরও মারফত পণ্যে পাটজাত মোড়কে বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা-২০১৩ এর তফসিলে পোল্ট্রি ও ফিস ফিড অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর ২৪ আগষ্ট ২০১৬ তারিখে একটি স্মারক লিপিতে পোল্ট্রি ফিডের গুণগত মান সঠিক রাখার শর্তে পাটের ব্যাগের পরিবর্তে পলি ব্যাগে মোড়কীকরণ যুক্তিযুক্ত বলে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ে জানান। ঠিক তেমনিভাবে মৎস্য অধিদপ্তরের ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিও তাদের মতামতে পাটের ব্যাগের পরিবর্তে বায়ু বিরোধী পলি ব্যাগে খাদ্যের গুণগত মান রক্ষার স্বার্থে যুক্তিযুক্ত বলে একমত পোষণ করেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এমনিতেই খাদ্যে জলীয় অংশ একটি নির্দিষ্ট মানে রাখতে হয়। তার জন্য ৩টি উপাদান খাদ্যে যোগ করতে হয় (মোল্ড ইনহিবিটর, টক্সিন বাইন্ডার ও এন্টি অক্সিডেন্ট)। অন্যদিকে জুট ব্যাগের উৎপাদন খরচ ১৩০ টাকা। যা প্রতি কেজিতে অতিরিক্ত খরচ পড়বে ২.৬০ টাকা। উল্লেখ্য বর্তমানে ব্যবহ্নত প্লাস্টিক ব্যাগে খরচ হয় প্রতি কেজিতে মাত্র ০.৬০ টাকা। ফলে খাদ্যের কেজি প্রতি বর্তমানের চেয়ে খরচ বাড়বে অতিরিক্ত ২ টাকা। যা ক্ষুদ্র ও মাঝারী খামারীদের ফার্ম পরিচালনায় নিরুৎসাহিত করবে, কেননা এখনি তারা উৎপাদন ব্যয় বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী কাঁচা মালের সরবরাহ লাইনে সংকটের ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যয় একবার বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার যদি আরও ২ টাকা কেজি প্রতি খাদ্যের ব্যয় বেড়ে যায় তবে শিল্পের উন্নয়ন তথা বৃদ্ধির হার ব্যাহত হবে। সরকার এই সেক্টরের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন ও সাস্টেইনএবল ডেভেলপমেন্ট-এর লক্ষ্য অর্জনে বাধাগ্রস্ত হবে।

আরও জানা গেছে যে, প্রতিমাসে যে পরিমাণ খাদ্য তৈরী হয় তার জন্য ৯৫,০০,০০০/- (পঁচানব্বই লক্ষ) থেকে ১,০০,০০,০০০/- (এক কোটি) ব্যাগ দরকার হয়, যাহা যুক্তিযুক্ত মূল্যে সরবরাহ করা কঠিন হবে। যদিও হয় তবে ভিতরে সেই পলিথিন ব্যাগই দিতে হবে। কেননা ভিতরে পলিথিনের ইনার লাইনার ময়েশ্চার/জলীয় অংশ নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই দরকার হবে। জানা গেছে অতি সম্প্রতি ৭টি পণ্যের জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হবে। এই ৭টি পণ্যের মধ্যে ২টি পণ্য হচ্ছে পোল্ট্রি ও ফিস ফিড। এই বিষয়ে আরও ভাবনা দরকার, যেখানে পুষ্টি বিজ্ঞানী, ফিড মিল এসোসিয়েশন, পোল্টি ফার্ম এসোসিয়েশন এবং এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও মাঠ পর্যায়ে এর প্রভাব ও সবার জন্য ভাল একটি মতামত থাকবে। সবার জন্য ভাল এমন বিজ্ঞ মতামত ও সুপারিশের অপেক্ষায় এবং বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করার জন্য আমাদের মতামত থাকবে।

লেখক:পোল্ট্রি কনসালটেন্ট, এসোসিয়েট ফর ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস লিঃ