অর্গানিক মুরগি ও ডিম উৎপাদনে অনুসরণীয় নীতিমালা

ভূমিকাঃ মুরগির মাংস এবং ডিম মানুষের খাদ্য তালিকায় আছে বহু প্রাচীনকাল থেকেই। তবে এই মুরগির মাংস এবং ডিমের উৎপাদনে ব্যবহৃত ক্ষতিকর বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক এবং এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা ব্যবহার মাংস এবং ডিমের প্রতি অনেক মানুষের আস্থা হারানোর কারণ হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় মুরগির মাংস এবং ডিমের মতো সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবারের প্রতি জনসাধারণের আস্থা ফিরিয়ে আনার একটি মাধ্যম হতে পারে অর্গানিক মুরগি এবং ডিম উৎপাদন। মহামারিতে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হলেও সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার হয়েছে১। তাই জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশে অর্গানিক খাবারের চাহিদা ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। তাই এই লেখনীতে আলোকপাত করছি অর্গানিক মুরগি ও ডিম নিয়ে।  

অর্গানিক মুরগি কি: অর্গানিক মুরগি বলতে ঐ সকল মুরগিকেই বুঝায় যাদের লালন পালন ও ব্যবস্থাপনার সকল ধাপে প্রাকৃতিক উপায় অবলম্বন করা হয়। যেমন অর্গানিক মুরগিকে অবশ্যই অর্গানিক খাবার খাওয়াতে হবে । ঐ মুরগিকে কোন প্রাণীজ উপজাত (Animal by-product) উপাদান এবং জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ক্রপ (GMO crop) বা শস্য খাওয়ানো যাবে না। এ ধরনের মুরগির খাদ্য তালিকায় কখনই কোন ধরনের এন্টিবায়োটিক রাখা যাবেনা।

অর্গানিক ডিম কি: সাধারণত অর্গানিক ডিম বলতে সেই ধরনের ডিম কে বোঝায়, যে ডিম পাড়া মুরগি গুলো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক মুক্ত খাবার খেয়ে বড় হয়েছে। এসব মুরগির জন্য রাসায়নিক সার বা কীটনাশক দিয়ে উৎপন্ন কোন খাবার ব্যবহার করা যাবে না, এবং এদের ঘুরে বেড়ানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গা দরকার হয়। এছাড়াও এসমস্ত মুরগির উপরে কোন ধরনের এন্টিবায়োটিক অথবা হরমোন ব্যবহার করা যাবে না।  

অর্গানিক মুরগি ও ডিম উৎপাদনের নীতিমালাঃ অর্গানিক মুরগি ও ডিম উৎপাদনের জন্য সুনিদিষ্ট কিছু নীতিমালা অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।  এধরনের মুরগিগুলো জৈবিকভাবে উর্বর মাটির উপর ভিত্তি করে সুস্বাস্থ্যের জন্য সামগ্রিক ইতিবাচক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এবং পরিবেশগত টেকসইযুক্ত পদ্ধতিতে পালন করতে হবে। অর্গানিক ডিম উৎপাদনে ব্যবহৃত মুরগিকে মাংসের উপজাতযুক্ত মাংস, যেমন মাংস এবং হাড়ের খাবার খাওয়ানো উচিত নয়। এই অর্গানিক (জৈব) ডিমগুলি অবশ্যই গভীর লিটার পদ্ধতিতে পালিত মুরগি থেকে আসতে হবে, যাতে মুক্ত পরিসরে পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকার থাকে। যা হোক, এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত সুনিদিষ্ট নীতিমালা অনুসরণই বাঞ্চনীয়।   

১। স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির জন্য একটি সতর্কতামূলক পদ্ধতি অবলম্বনীয়।
২। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থাপনার চেয়ে ইতিবাচক ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।  
৩। উপসর্গের পরিবর্তে স্বাস্থ্য সমস্যার মৌলিক কারণগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে।
৪। কৃত্রিম প্রক্রিয়ার পরিবর্তে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৫। মাথা পিছু মুরগি প্রতি জায়গার পরিমান বাড়াতে হবে এবং পারত পক্ষে নিবিড় আবাসন পরিত্যাগ করতে হবে।
৬।ধীর বর্ধনশীল জাতগুলি পালনে উত্সাহিত করতে হবে।
৭। শুধুমাত্র যে সকল প্রাণী আসলে অসুস্থ হয় তাদের চিকিত্সা করতে হবে এবং প্রয়োজন ছাড়া কোন রুটিন ড্রাগ চিকিত্সা হিসাবে ব্যবহার না করা।   
৮। প্রতিষেধক এর চেয়ে প্রতিরোধ মূলক চিকিৎসা বেশি পছন্দ করতে হবে।
৯। প্রতিটি খামারের জন্য পশু স্বাস্থ্য পরিকল্পনা বাধ্যতামূলক, সুস্বাস্থ্যের জন্য ফার্মের প্রয়োজনীয় দুর্বলতা এবং উন্নতিগুলি চিহ্নিত করতে হবে।
১০। ফার্মের রেকর্ড রাখতে হবে।   
১১। ফারটিলিটি সহ স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য টেকসই প্রজনন কৌশল তৈরি করতে হবে।

সার্টিফাইড অর্গানিক ডিমের শর্তাবলীঃ  
একটি প্রত্যয়িত অর্গানিক ডিম উৎপাদনের জন্য যে মুরগি ডিম দেয় তাকে অবশ্যই জৈবিকভাবে প্রত্যয়িত (অর্গানিক) হতে হবে অথবা যদি একটি প্রচলিত উৎস থেকে ডিমগুলি প্রত্যয়িত হয়, তাহলে অন্তত ছয় মাস আগে জৈব (অর্গানিক) খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। অর্গানিক ডিম উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিছু নিয়ম নিম্নরূপঃ   

১। অর্গানিক ডিম পাড়ার মুরগিকে খাওয়ানোর জন্য ব্যবহৃত সমস্ত উপাদান অবশ্যই প্রত্যয়িত জৈব ((অর্গানিক) উৎস হতে হবে। কোন ভেষজনাশক, ছত্রাকনাশক, কীটনাশক বা রাসায়নিক সার অনুমোদিত নয়।
২। টেকসই উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে খামারি কে অবশ্যই মাটির উর্বরতা স্বাভাবিকভাবে পূরণ করতে হবে।
৩। আবাসনকে (সেড) অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত স্বাধীনতা, স্বাভাবিক সামাজিকীকরণ, সর্বাধিক তাজা বাতাস, দিনের আলো এবং প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৪। মুরগিগুলোকে অবশ্যই মুক্ত পরিসীমা বা বড় খোলা বাতাসে প্রবেশ করতে দিতে হবে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ/মাটির সাথে যোগাযোগ করতে দিতে হবে।
৫। অর্গানিক ডিম উৎপাদনকারী ঝাঁকে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক, নিষিদ্ধ পরজীবীনাশক বা ককসিডিওস্ট্যাট অনুমোদিত হবে না।
৬। চিকিত্সার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা অবলম্বন করতে হবে।
৭। সর্বোপরি, দায়িত্ব প্রাপ্ত/অনুমোদিত কোন সরকারী সংস্থা কর্তৃক একটি প্রশংসাপত্র প্রদান করতে হবে যাতে বলা হয় যে ডিমগুলি প্রত্যয়িত জৈব (অর্গানিক) ।

অর্গানিক মুরগি ও ডিম এর পুষ্টিগুনঃ
অতিরিক্ত ভিটামিন ও খনিজ এর উৎসঃঅর্গানিক মাংসে ও ডিমে ভিটামিন এ এবং ই এর মাত্রা সাধারণ মাংস ও ডিমের তুলনায় বেশি। আর ভিটামিন এ এবং ই আপনার চুল ত্বক, এবং নখের গভীর থেকে পুষ্টি যোগায়। এছাড়া অর্গানিক ডিমে রয়েছে বিটা-ক্যারোটিনের এক বিশাল ভান্ডার যা কিনা আপনার হৃদরোগ কমাতে সাহায্য করে থাকে। এছাড়া অর্গানিক ডিমে পাওয়া নানা ধরণের এন্টি-অক্সিডেন্ট আপনার শরীরের লোহিত কণিকা এবং স্নায়ু কোষের ক্ষতিপূরণ করে থাকে। গর্ভবতী মা ও শিশুর ভিটামিন, ক্যালসিয়াম এবং অনান্য ঘাটতি পূরণ ও সার্বিক বিকাশে এ মাংস ও ডিম সহায়ক। তাছাড়া বাড়ন্ত শিশুর অফুরন্ত প্রাণশক্তি বাড়াতে, দৈহিক ও মেধার বিকাশে, অস্থি ও হাড়ের গঠনে এ মাংস ও ডিম সহায়ক।

স্বাস্থ্যসম্মত ফ্যাটঃ  
বেশ কিছু গবেষণা থেকে জানা যায়, সাধারণ ডিমের তুলনায় অর্গানিক ডিমে ওমেগা-৩ ও ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। ওমেগা-৩ এমন একটি প্রয়োজনীয় ফ্যাট যা আপনার শরীরে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং আপনার মস্তিষ্ক বিকাশে সহায়তা করে। এছাড়াও সাধারণের তুলনায় অর্গানিক  ডিমে তিনভাগের একভাগ কোলেস্টেরল এবং চারভাগের একভাগ সম্পৃক্ত ফ্যাট থাকে। যার ফলে অর্গানিক ডিম আপনার শরীরের হেলদি ফ্যাট কাউন্ট বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। অর্গানিক ডিম ওমেগা ৩ ও হারবাল গুণাবলি সম্পন্ন। এতে ক্ষতিকারক LDL Cholesterol এর পরিমাণ অনেক কম। যা হার্টকে রাখে সতেজ।

রোগ ব্যাধির ঝুঁকি কমায়ঃ
অর্গানিক মাংস ও ডিমে থাকা স্বাস্থ্যসম্মত ফ্যাট, বিভিন্ন রকমের ভিটামিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আপনার ইমিউন সিস্টেমকে আরো শক্তিশালী করে, যার ফলে নানা ধরনের রোগ বালাই থেকে আপনি সুস্থ থাকতে পারেন। এছাড়াও ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশক, সার, এবং এন্টিবায়োটিক ব্যবহার না হওয়ায় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপাদান এর মাধ্যমে আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারবে না। বয়স্কদের জয়েন্ট পেইন, মাইগ্রেন ও হাড়ের ক্ষয় রোধ করে।

পরিশেষঃ  
মাংস ও ডিম আমাদের সবারই প্রয়োজনীয় ও প্রিয় খাদ্য। কিন্তু এই মাংস ও ডিম খেয়ে যদি কোন উপকার না হয় বরং ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় তাহলে ব্যাপারটি হয়ে দাঁড়ায় খুবই দুঃখজনক। তাই নিজের ও পরিবারের সুস্বাস্থ্যের জন্য সঠিক খাদ্য নির্বাচনে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে “আমরা বাঁচার জন্য খাই, খাওয়ার জন্য বাঁচি না”। সুতরাং অর্গানিক মাংস ও ডিম নির্দ্বিধায় বেছে নিতে পারেন।   মানসম্মত খাদ্য নির্বাচন করুন, ভালো খান, সুস্থ থাকুন।

তথ্যসুত্রঃ  
১। দ্য ডেইলি স্টার, অনলাইন রিপোর্ট, বৃহস্পতিবার, আগস্ট ৫, ২০২১
২। Sultan S, Begum R, Rahman MA, Ahmed MJU, Islam MM and Haque S. Economic analysis of antibiotics use and vaccine program in commercial broiler farming of Tangail district in Bangladesh. Progressive Agriculture.  2016;27 (4): 490-501.
লেখকঃ
ড. মোঃ শরিফুল ইসলাম
অধ্যাপক
ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস বিভাগ
ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সেস অনুষদ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
E-mail: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
মোবাইলঃ ০১৭৮০৬৯১৫৬০