দুগ্ধ শিল্পে সমবায় এবং বর্তমান প্রেক্ষিত

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

প্রফেসর ড. খান মো: সাইফুল ইসলাম:মিষ্টির দোকানের মিষ্টি খেতে খুবই মিষ্টি। একজন বিদেশি বলেছিলেন “চিনির দলা”। এমনি এমনি কিন্তু মিষ্টি করা হয়নি। অনেক আগে থেকেই দুধ বা দুগ্ধজাত দ্রব্যকে পচনশীলতা থেকে রক্ষা করার জন্য অধিক চিনি যোগ করা হত। একদিকে দুধ অনেক পুষ্টিকর ও একটি অনন্য আদর্শ খাবার হলেও এদেশের গরম আবহাওয়া ও দুধে বিদ্যমান সুষম পুষ্টির উপস্থিতিতে জীবাণু সহজেই বৃদ্ধি পায় যা দুধের পচন সৃষ্টি করে। শীতলীকরনের মাধ্যমে সংরক্ষন ব্যবস্থা না থাকার কারনে দুগ্ধজাত দ্রব্যে অধিক চিনি সংযোগই ছিল পচন রোধের একমাত্র ব্যবস্থা।

দুধ সহজেই পচনশীল হওয়ার কারনে ও ভাল কোন সংরক্ষনব্যবস্থা না থাকায় মিষ্টান্ন কারখানাই ছিল এক সময়কার একমাত্র দুগ্ধ শিল্প। আর মিষ্টির দোকানসমূহ ছিল বিশেষায়িত দুগ্ধ বিতান। এসকলই ছিল স্থানীয় পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা। যেহেতু দুধ সহজে পচে যায় তাই মধ্যস্বত্বভোগীরা সেই সুযোগ নিয়ে স্বল্প মূল্যে দুধ ক্রয় করে মিষ্টির দোকানে সরবারহ করত। আর এই মিষ্টির দোকান মিষ্টি সহ অন্যান্য সামগ্রী তৈরী করে স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রি করত। তাই দেশের সর্বত্র দুধের মূল্যের ব্যপক তারতম্য দেখা যেত। আজ অনেক বছর পরও এই তারতম্য বিরাজমান। এই তারতম্যই দুগ্ধ শিল্পের আবশ্যকতা নির্দেশ করে।

দুগ্ধ উৎপাদনকারীর মধ্যস্বত্বভোগীর উপর নির্ভরশীলতা তাকে অসহায় করে তোলে। দুগ্ধ উৎপাদনে আগ্রহ হারানোর মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত তথা জাতীয় উন্নয়ন ব্যহত হয়। তাই মধ্যস্বত্বভোগীর উপর নির্ভরশীলতা কমানো সহ তাদের একচেটিয়া মূল্য নির্ধারন উপেক্ষা করার জন্য নীতিনির্ধারকগন সমবায় ব্যবস্থা প্রনয়নের সুপারিশ করেন। ১৯৪৬ সালে ভারতে “আমুল” প্রথম এই ব্যবস্থা প্রনয়ন করেন। এই ব্যবস্থায় প্রতি খামারি সমবায় প্রতিষ্ঠানের মালিক। সমবায় পদ্ধতিতে এক দিকে কৃষক তার উৎপাদিত দুধ বাজারজাতকরনের নিশ্চয়তা পাবেন, অন্যদিকে সে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সেবা পাবেন। ফলে খামারিগনের মধ্যস্বত্বভোগীর উপর নির্ভরশীলতা কমতে থাকবে। তবে যখন এই ব্যবস্থা প্রনয়ন করা হয়েছিল তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে বর্তমান অবস্থার যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বর্তমান সময়ে প্রতিযোগীতামূলক বাজার ব্যবস্থায় সমবায় কতখানি কার্য্যকর তা আজ খতিয়ে দেখা দরকার।

সমবায় ব্যবস্থা অনুসরনে মধ্যস্বত্বভোগীদের উপর নির্ভরশীলতা কমলেও খামারিগন সমবায় কাঠামোর ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সমবায় কাঠামোর ব্যবস্থাপনার দক্ষতার উপর নির্ভর করে খামারির লাভ ও লোকসান। এই ধরনের নির্ভরশীলতা সাধারন প্রান্তিক খামারির অসহায়ত্ব বাড়িয়ে দেয়। ব্যবস্থাপনার অদক্ষতার ফলে যদি অধিক ব্যায় হয় তবে তা লোকসান বলে বিবেচিত হবে। কখনো কখনো লোকসান যাতে সহনশীল হয় এবং খামারি যাতে আগ্রহ হারিয়ে না ফেলে তাই প্রাথমিক খামারি পর্যায়ে ভর্তুকী দেয়া হয়। এই ভর্তুকির অর্থ সংস্থান হয় সাধারন জনগনের অর্থ থেকে।

মনে করুন প্রতি লিটার দুধের দাম কৃষক পর্যায়ে ৫০ টাকা। ভোক্তা ৬০ টাকা মূল্যে দুধ ক্রয় করে। যে ১০ টাকা তারতম্য হয় তার ৫ টাকা খরচ পরে ব্যবস্থাপনা, রক্ষনাবেক্ষন, সার্ভিস, বীমা, সুদ ইত্যাদি বাবদ। বাকী ৫ টাকা বোনাস আকারে খামারি নিজেই পেয়ে থাকেন। যদি এই অবস্থায় খামারি খুশি থাকে তবেই সমবায়ের সফলতা। কিন্তু যদি প্রতিযোগীতামূলক বাজার অনুসরন করে ৫০ টাকা ক্রয়মূল্য নির্ধারন করতে হয় এবং যদি বিক্রয়ের সময়ও প্রতিযোগীতামূলক বাজার অনুসরন করে ৬০ টাকা নির্ধারন করতে হয়। তখন একটি বাড়তি চাপ পড়ে সমবায়ের উপর। ফলে সরকারী অনুদান খুজতে হয়। যদি এই ভারসাম্য রক্ষা করতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয় তবে বাড়তি ব্যয় কিন্তু প্রতি লিটার দুধের উপড়ই বর্তায়। অর্থাৎ দুধের প্রকৃত মূল্য অনেক বেশী পড়ে যায়। বিভিন্ন দেশে এসকল খাতে সরকার ভর্তূকী দেয় যাতে ভোক্তা কম মূল্যে কোন সামগ্রী ক্রয় করতে পারে। কিন্তু সেটি প্রতিযোগীতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য নয়। তাই আজ প্রশ্ন উঠেছে প্রতিযোগীতামূলক বাজারে সমবায় কতখানি কার্য্যকর ?

১৯৯৭ সাল, টাঙ্গাইল চিলিং কেন্দ্র। কেন্দ্রটি চালু রাখার জন্য সরিষাবাড়ি থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরাই দুধ সরবারহ করত। মাধ্যম ছিল স্থানীয় সমবায় সমিতি। সমিতিগুলো ছিল কেবলমাত্র কাগজ-কলমে আর সাইন র্বোড সর্বস্ব। কেন্দ্রটি মূলত রাখা হয়েছিল অবাধ্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের ডাম্পিং পয়েন্ট হিসেবে।

১৯৯৮ সাল। পাবনা এলাকা। সমবায় সমিতির সদস্যগন অনাগ্রহ প্রকাশ করত সমিতিতে দুধ সরবারাহ করতে। এলাকায় মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রকোপ বেড়ে যায়। প্রবেশ করে অন্যান্য বেসরকারী দুগ্ধজাত দ্রব্য বাজারজাতকরন প্রতিষ্ঠান। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল যে, সমবায় প্রতিষ্ঠানের মূলনীতি হয়ত কাজ করছে না। হয়ত এলাকার খামারি সমবায় সমিতি থেকে অপেক্ষাকৃত বেশী মূল্যে দুধ বিক্রি করত ঐসকল বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। আজ প্রশ্ন জাগে, যে কারনে সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিল সেই কারন বিরাজমান আছে কিনা।

খামারি প্রতিযোগীতামূলক মূল্যে দুধ বিক্রি নিশ্চিত করতে পারলে সেখানে সমবায় ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে কি না তা বিশ্লেষন করে দেখা দরকার। শুধু তাই নয়, সমবায় ব্যবস্থাপনায় সরকারী অর্থ বিনিয়োগ করে প্রকৃত অর্থে প্রতি একক দুধের মূল্য কত সেটিও আজ দেখার বিষয়। পূর্বে খামারী বাধ্য হয়ে স্থানীয় বাজারে দুধ বিক্রি করত। আজ স্থান ভেদে যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে। কারন ছোট ছোট দুগ্ধ শিল্প এগিয়ে এসেছে এই সেক্টরে। আর তাই খামারি প্রতিযোগীতামূলক মূল্যে দুধ বিক্রি করতে পারছে। সেখানে কি সমবায় ব্যবস্থা কার্যকর হবে ?

দুগ্ধ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরন ও বিপননকে শিল্প আকারে বিবেচনা করতে হবে। কারন দেশের উন্নয়নের অন্যতম শর্ত শিল্প বিপ্লব। ফলে খামারি, দুধ প্রক্রিয়াজাত করন কারখানা ও বিপনন সংগঠনসমূহ সরকারের নজরদারি ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যম্যে প্রতিযোগীতা মূলক বাজার তৈরী করবে। ফলশ্রুতিতে খামারি তার দুধের সঠিক মূল্য পাবে। শুধু তাই নয় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। যা কেবলমাত্র শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমেই সম্ভব। কারন শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষকের মধ্যেও প্রতিযোগীতা দেখা দিবে এবং খামারি তার খামারের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য অত্যানুকুল পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করবে।

সময়ের সাথে সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। প্রযুক্তিগত অনেক উন্নতি অব্যহত রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে প্রতিযোগীতামূলক বাজার তৈরি হচ্ছে বিধায় সকল উপ-বিভাগে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতি সমবায় সংগঠন প্রতিষ্ঠাকালে বিরাজমান ছিলনা। তাই আজ সময় এসেছে এই সেক্টর ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবার। এই সেক্টরে বেশী করে বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্টানকে উৎসাহিত করতে হবে যাতে ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগীতা সৃষ্টি হয়। ফলে দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিযোগীতামূলক মূল্য পাবে আর ভোক্তা প্রতিযোগীতামূলক বাজারে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য ক্রয় করতে পারে। এভাবে খামারির উৎপাদনশীলতা থেকে সকল ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। এরকম একটি ভারসাম্যপূর্ন অবস্থায় যদি জনগনের অর্থে এই সেক্টরে ভর্তূকী দেয়া হয় তবে সেটিই অর্থবহ। মনে রাখতে হবে খামারিকে বাচিয়ে রাখার জন্য ভর্তূকী কোন স্থায়ী সমাধান নয়। সর্বস্তরে দক্ষতা বৃদ্ধি আবশ্যক।
-লেখক-পশু পুষ্টি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.