নিরাপদ কৃষি: বন্ধু পোকামাকড় বংশ বিস্তার এবং বালাইনাশকের ঝুঁকি হ্রাসে করনীয়

ড. জগৎ চাঁদ মালাকার:মাঠফসল, বসতবাড়ির সবজি ও ফল আবাদের সমস্যাসমূহের মধ্যে পোকা ও রোগের আক্রমন প্রধান। যে কোন ফসলের রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রন করতে হলে প্রথমে ঐ রোগ ও পোকা সনাক্ত করণে কৃষকগণ দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। মাঠফসল, সবজি ও ফলের পোকা ব্যবস্থাপনার প্রথম বিবেচ্য হচ্ছে পোকা চেনা, পোকার ক্ষতিকর পর্যায় জানা, ক্ষতির লক্ষণ জানা ও ক্ষতিকর পোকার জীবনের বিভিন্ন ধাপ সমূহের অবস্থান জানা। এছাড়া পোকার উপস্থিতি, ব্যাপকতা ও ক্ষতি করার ক্ষমতা যদি কম হয় তখন ব্যবস্থাপনা না নিলেও হয়। এছাড়া সমন্বিত পদ্ধতিতে পোকা ও রোগ দমনের সহজ প্রাপ্য পদ্ধতি সমূহের সমন্বয় করা হয় এবং গাছের বৃদ্ধির কোন পর্যায়ে কোন পোকা ও কোন অংশে কোন পোকা বা রোগ আক্রমন করে তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিলে বালাইয়ের আক্রমন হার সর্বনিম্ন থাকে এবং ফসলের উৎপাদন আর্থিকভাবে ক্ষতিকর হয় না।

আইপিএমের আলোকে মাঠফসল, বসতবাড়ির সবজির ও ক্ষতিকর পোকা ও রোগর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সমূহ:

১। জৈবিক ব্যবস্থাপনা- উপকারী পোকামাকড়ের বংশ বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য জমিতে এলোপাতারি বালাইনাশক ব্যবহার না করা।
২। বালাই সহনশীল জাতের আবাদ-বারি বেগুন-৭,৮, বেগুনের মাজরা পোকা সহনশীল, কাঁটাযুক্ত, লম্বাটে বেগুনে পোকা কমলাগে।
৩।আধুনিক চাষাবাদ-সুস্থ বীজ ও চারা রোপন, শস্য পর্যায় অনুসরণ, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ, ফসল সংগ্রহের পর অবশিষ্টাংশ পুড়ে ফেলা, সঠিক দুরত্বে লাগানো, সমকালীন চাষাবাদ, পানি ব্যবস্থাপনা, সার ব্যবস্থাপনা, নিয়মিত মাঠ জরীপ, বিকল্প পোষক ধ্বংশ করা, গন্ধযুক্ত ফসলের আন্ত:ফসল আবাদ, ফাঁদ ফসলের চাষা করা।
৪। যান্ত্রিক পদ্ধতি-হাত জাল দিয়ে পোকা ধরা, বিষটোপ ফাঁদ ব্যবহার, ডাল পোতা, ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার, ডিম গাদা সংগ্রহ করে নষ্ট করা, আক্রান্ত ডগা, ফল সংগ্রহ করে পুতে ফেলা, বাগিং করা, শুকনো ছাই দেওয়া, মশারী দিয়ে ঢেকে দেওয়া, পরিস্কার পানি স্প্রে করা, জোড় কলম করা-বনবেগুন+বেগুন, সাবানের গুড়া স্প্রে করা।
৫।বালাইনাশক ব্যবহার- রোগের আক্রমন বেশি হলে (ক) উদ্ভিজ্জ-নিমতৈল, নিমবীজের শ্বাসের চূর্ণ, নিশিন্ধা, বিষকাটালী, মেহগনীর বীজ, পাট বীজ, তামাক পাতা। (খ) রাসায়নিক-সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসাবে(ক) সঠিক বালাইনাশক খ) সঠিক মাত্রা গ) সঠিক পদ্ধতি ও ঘ) সঠিক সময় মেনে-কম স্থায়ী, স্পর্শ বিষ ব্যবহার করা।

বন্ধু (উপকারী) পোকামাকড়
বর্তমানে কৃষকরা সবজির জমিতে এলোপাতারি বালাইনাশক ব্যবহার করছেন যা একদিকে আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর অন্যদিকে কৃষকদেরও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে চলছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য জৈবিক দমন একটি ভাল উপায়। সফলভাবে জৈবিক দমন করতে হলে আমাদের উপকারি পোকামাকড় (পরভোজী ও পরজীবি) সংরক্ষণ ও লালন-পালন করার কৌশলসমূহ জানতে হবে এবং তা যথারীতি প্রয়োগ করতে হবে। কৃষকদেরকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি বন্ধু পোকামাকড় (পরভোজী ও পরজীবি) সংরক্ষণ ও লালন-পালন করার জন্য বিষয়টি খুবই জরুরি।

আবার কিছু পোকামাকড় আছে, যে গুলি সবজির ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে বা ধ্বংস করে থাকে এরা উপকারী পোকামাকড় হিসেবে পরিচিত। যে সকল উপকারী পোকামাকড় ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে বা ভোজন করে ধ্বংস করে সেগুলি পরভোজী পোকামাকড়। পক্ষান্তরে কিছু উপকারী পোকামাকড় এর জীবনচক্র কিছু ক্ষতিকর পেকামাকড় এর জীবনকে ধ্বংস বা ক্ষতিকরে সম্পন্ন করে সেগুলি পরজীবি পোকামাকড়।

পরভোজী পরভোজী শব্দের অর্থ অপরকে ভোজন করে যে। যে জীব অন্য জীবকে খেয়ে বা ভোজন করে বেঁচে থাকে তাকে পরভোজী বলে। পরভোজী পোকা সাধারণত শিকার পোকা অপেক্ষা বড় অথবা সমান হয়ে থাকে। পরভোজীর বৈশিষ্ট্য হলো- একটি পরভোজী পোকা বিভিন্ন পোকা খায়, পরভোজী পোকা অনেক সংখ্যক শিকার করে, শিকারকে খেয়ে বা শিকারের দেহ রস চুষে নিয়ে তাকে মেরে ফেলে। সাধারণতঃ বাচ্চা ও বয়স্ক উভয়ই শিকার করে। পরভোজীরা তার শিকার খেয়ে আলাদাভাবে বৃদ্ধি পায়, স্ত্রী-পুরুষ উভয়ই শিকার করে। যেমন বাচ্চা ও পূর্ণবয়স্ক পরভোজী লেডিবার্ড বিটল বাচ্চা বা পূর্ণবয়স্ক শিকার জাব পোকা সরাসরি খেয়ে ধ্বংস করে। এরা ধীর গতিতে চলাচল করে। পরভোজী পোকা যে প্রক্রিয়ায় শিকার পোকাকে খায় বা ভোজন করে তাকে পরভোজীতা বলে। পরভোজী মাকড়সা,লেডিবার্ড বিটল,ক্যারাবিড বিটল,স্টেফিনিলিড বিটল ইত্যাদি।

পরজীবি শব্দের অর্থ পরের জীবনের উপর যে নিজের জীবন চালায় বা অন্যের উপর জীবন ধারণ করে ও মেরে ফেলে। যে জীব অন্য জীবের উপর আশ্রয় নেয় ও তার দেহ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে এবং শেষে মেরে ফেলে বা শিকারের জীবনের ক্ষতি করে তাকে পরজীবি পোকা বলে। পরজীবি পোকা শিকার পোকা অপেক্ষা ছোট হয়ে থাকে। পরজীবির বৈশিষ্ট্য হলো উচ্চ অনুসন্ধান ক্ষমতাসম্পন্ন, সহজেই পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে, অধিক বংশবৃদ্ধি ক্ষমতাসম্পন্ন, সহজেই ল্যাবরেটরিতে উৎপাদন করা যায়, কম উৎপাদন খরচ, পোষক পোকার সাথে তার জীবনচক্রের সামঞ্জস্যতা থাকে, সুনির্দিষ্ট আক্রমণ ক্ষমতা রয়েছে। পরজীবি পোকা যে প্রক্রিয়ায় শিকার পোকাকে ধ্বংস বা ক্ষতি করে তাকে পরজীবিতা বলে।

পরজীবী বোলতা
পূর্ণবয়স্ক পরজীবি বোলতা যেমন ট্রাইকোগ্রামা, টেলিনোমাস, টেট্রাসটিকাস ইত্যাদি ক্ষতিকর পোকা যেমন মাজরা পোকার ডিমের গাদায় ডিম পাড়ে। বোলতার ডিম মাজরা পোকার ডিমের ক্ষতিসাধন করে নিজের জীবনচক্র সম্পন্ন করে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়ে বেরিয়ে আসে এবং পরিশেষে মাজরার ডিমগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

উপকারী পোকামাকড় ও জীবের বংশ বিস্তার এবং সংরক্ষণ
বর্তমানে কৃষকরা ফসলের জমিতে এলোপাতাড়ি বালাইনাশক ব্যবহার করছেন যা একদিকে আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর অন্যদিকে কৃষকদেরও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে চলছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য জৈবিক দমন একটি ভাল উপায়। সফলভাবে জৈবিক দমন করতে হলে আমাদের উপকারি পোকা-মাকড় (পরভোজী ও পরজীবি) সংরক্ষণ ও লালন-পালন করার কৌশল সমূহ জানতে হবে এবং তা যথারীতি প্রয়োগ করতে হবে।

বন্ধু পোকামাকড় (পরভোজী ও পরজীবি) সংরক্ষণ ও লালন-পালন কী?
এলোপাথারি কীটনাশক ছিটিয়ে বন্ধু পোকামাকড় না মেরে তাদেরকে প্রাকৃতিকভাবে অথবা বিভিন্ন বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের সংখ্যা বাড়ানোকে বন্ধু পোকামাকড় (পরভোজী ও পরজীবি) সংরক্ষণ ও লালন-পালন বলে।

বন্ধু পোকামাকড় (পরভোজী ও পরজীবি) সংরক্ষণ ও লালন-পালনের উদ্দেশ্য:
শক্রুপোকার সংখ্যা কমিয়ে/নিয়ন্ত্রণে রাখা।উপকারি পোকা-মাকড়ের সংখ্যা বাড়ানো।উৎপাদন খরচ কমিয়ে রাখা। কীটনাশকের ব্যবহার কমানো। পরিবেশের ভারসাম্য রজায় রাখা।

বন্ধু পোকামাকড় (পরভোজী ও পরজীবি) সংরক্ষণ ও লালন-পালন (বংশ বিস্তার) পদ্ধতিসমূহ:
উপকারী পোকামাকড় সংরক্ষণের প্রধান উপায় হল জমিতে এলোপাতাড়ি কীটনাশক ব্যবহার না করা। উপকারী পোকামাকড় রঙিন ফুলজাতীয় সবজিতে আশ্রয় নিয়ে থাকে। জমিতে ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ হলে তখন এই উপকারি পোকামাকড়ই ক্ষতিকারক পোকা খেয়ে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

১. চিটাগং পদ্ধতি বা আইল ফসলের চাষঃ জমির আইলে রঙিন ফুল হয় এমন সবজি (বিশেষ করে বরবটি,শিম, করলা) চাষ করলে সেখানে বিভিন্ন প্রকার বন্ধু পোকার আশ্রয়স্থল তৈরি হয়। এতে করে বন্ধুপোকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তখন জমিতে শক্রু পোকার আক্রমণ হলে এসব বন্ধু পোকা জমির শক্রু পোকা খেয়ে জমির ক্ষতিকর পোকা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
২. চায়না পদ্ধতিঃ এ পদ্ধতিতে  ফসল কাটার সময় ক্ষেতের আইলে খড় বিছিয়ে দেয়া হয়। ফসল কাটার পর ক্ষেত যখন খালি হয়ে যায় তখন আইলে রক্ষিত খড়ের নিচে মূলত মাকড়সা, ক্যারাবিড বিটল, স্টেফাইলিনিড বিটল এসব উপকারী পোকা মাকড়সাগুলো আশ্রয় নেয় এবং তাদের বংশ বিস্তার করে। পরে জমিতে নতুন ধান ফসল লাগাবার পর এ সকল পরভোজী পুনরায় ক্ষেতে আগমন করে। সুদূর চীন দেশে এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় বলে এটিকে চায়না পদ্ধতি বলে।
৩. বাঁশের বুস্টার পদ্ধতিঃ এই পদ্ধতিরে জন্য প্রথমে ৪/৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে বাঁশ নিয়ে বাঁশের ওপর দিক থেকে একটি গিঁটের নিচেই ১ইঞ্চি/১ ইঞ্চি পরিমাণ কেটে নিতে হবে। কাটা অংশের চার পাশে আঠাযুক্ত পদার্থের প্রলেপ দিতে হবে। আঠা যাতে করে শুকিয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাঁশের খুঁটির মাথায় টিনের কৌটা দিয়ে এমনভাবে ঢাকনি দিতে হবে যেন ছিদ্র দিয়ে বাঁশের ভিতর পানি না ঢুকতে পারে। ক্ষেত থেকে পোকার ডিমের গাদা পাতাসহ সংগ্রহ করে বাঁশের কাটা অংশ দিয়ে বাঁশের ভিতরে ফেলতে হবে। ডিমগুলি যদি পরজীবি দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে কদিন পর বাঁশের ছিদ্র পথে বোলতা বেরিয়ে জমিতে ছড়িয়ে পড়বে আর যদি পোকার ডিম পরজীবি দ্বারা আক্রান্ত না হয় তবে তা থেকে ক্ষতিকর পোকার কীড়া বের হয়ে যাওয়ার সময় বাঁশের ছিদ্রের চারপাশে দেয়া আঠায় আটকে মারা যাবে। এত করে বন্ধু পোকার সংখ্যা বাড়তে থাকবে। এই পদ্ধতিতে উপকারী পোকামাকড় সংখ্যা বাড়ানো করা যাবে।
৪.পলি ব্যাগে পোকা পালন করাঃ এই পদ্ধতিতে পোকার ডিম সংগ্রহ করে পলি ব্যাগে রাখতে হবে। পলিব্যাগে পানি ভেজানো তুলা ঢুকিয়ে দিতে হবে। ডিম ফোটার পর যদি দেখা যায় তা উপকারী পোকা তবে তা জমিতে ছেড়ে দিতে হবে। আর যদি দেখা যায় ক্ষতিকর পোকা তবে তা মেরে ফেলতে হবে। এইভাবে বন্ধু পোকা পালন করে সংখ্যা বাড়ানো যায়।
৫.এলোমেলোভাবে কীটনাশক ব্যবহার না করাঃ বেশির ভাগ উপকারি পোকামাকড় ফসলের উপরের দিকে থাকে বিধায় এলোমেলো কীটনাশক ব্যবহার করলে উপকারি পোকা মাকড় মারা যাবে।তাই এলোমেলো কীটনাশক ব্যবহার না করা এতে উপকারী পোকামাকড় সংখ্যা বাড়ানো করা যাবে।
৬. বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ল্যাবরেটরীতে পরজীবি জাতীয় পোকার উৎপাদন : ফিলিপাইন, ইন্ডিয়া, চায়না এসকল দেশে ল্যাবরটরিতে বিভিন্ন ধরণের বোলতা উৎপাদন করা হয় এবং তারপর তাদেরকে ফসলী জমিতে ছাড়া হয়। আমাদের দেশে বি.এ.আর.আই,এ পদ্ধতি এখনো গবেষণা করছে এবং ইস্পাহানি বায়োটেক ল্যাবরটরিতে বিভিন্ন ধরণের পরভোজী উৎপাদন পোকা, বোলতা উৎপাদন ও বাজারজাত করছে।

সংরক্ষণ পদ্ধতি
ক) ফসল কাটার সাথে সাথে জমি চাষ না করে কয়েক ঘণ্টা (অনুমানিক ৬-৮ ঘন্টা)  অপেক্ষা করা এবং এরপর জমি চাষ করা যাতে ক্ষেতের উপকারী পোকা মাকড়সাগুলো আইলে খড় কুটার মধ্যে অথবা ঘাসে আশ্রয় নিতে পারে।
খ) ধানের ক্ষেতে ফসলের স্তরের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি রাখা যাতে পানির উপকারী পোকাগুলো বাচঁতে পারে। পানি শুকিয়ে গেলে পানির  উপকারী পোকাগুলো আর সেখানে থাকতে পারে না।
গ) যে এলাকায় উপকারী পোকা মাকড়সা পর্যাপ্ত সেখান থেকে স্থানান্তর করে অন্য জায়গায় যেখানে এরা অপর্যাপ্ত সেখানে ছেড়ে দেয়া। এ পদ্ধতি বিভিন্ন উন্নত দেশে অনুসরণ করা হয়। আমাদের দেশে এখনো এটি অনুসরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
ঘ) বালাই নাশকের এলোপাতাড়ি ব্যবহার বন্ধ করা।

সেক্স ফেরোমন ফাঁদ
সেক্স ফেরোমন হচ্ছে এক ধরণের জৈব রাসায়নিক পদার্থ যা কোন নির্দিষ্ট প্রজাতির স্ত্রী পোকা কর্তৃক একই প্রজাতির পুরুষ পোকাকে প্রজনন কার্যে আকৃষ্ট করার জন্য প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয়। সেক্স ফেরোমনের গন্ধে পুরুষ পোকা আকৃষ্ট হয়ে স্ত্রী পোকার সহিত মিলিত হয়। স্ত্রী পোকা কর্তৃক নিঃসৃত পদার্থের গন্ধটি কৃত্রিমভাবে তৈরী করে সেক্স ফেরোমন ফাঁদে ব্যবহার করা হয়। সাধারণতঃ দুই থেকে চার ধরনের রাসায়নিক উপাদানের সংমিশ্রণে সেক্স ফেরোমন তৈরী করা হয়। ফাঁদটি সহজলভ্য ও সস্তা দ্রব্য দিয়ে তৈরি অথচ পোকা ধরার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারের সুবিধা  এটি মানুষ কিংবা পরিবেশের কোন ক্ষতি করে না।

সেক্স ফেরোমন ফাঁদের সুফল: সেক্স ফেরোমন ব্যবহারে উৎপাদন খরচ অনেক কমে যায়।ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় কার্যকরভাবে দমন করা যায়। বালাইনাশকের বিরুদ্ধে পোকামাকড়ের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় না। ফলন বৃদ্ধি পায়।ফেরোমন ফাঁদ স্থাপনের উদ্দেশ্য অধিক হারে পুরুষ পোকা আটকানো এবং পোকার উপস্থিতি মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণ করা, অপকারি পোকার প্রজনন কাজে বাধার সৃষ্টি করা।

বালাইনাশক ব্যবহারের কুফল ও কিভাবে ঝুঁকি হ্রাস করা যায়
বালাইনাশক হচ্ছে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা ফসলের ক্ষতিকর পোকা মাকড়, রোগ, আগাছা ইত্যাদি বালাই দমনের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এজন্য কৃষকরা বালাই দমনের জন্যে বালাইনাশক ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বালাইনাশকের অনেক রকম মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। যেমন- কীটনাশক শুধু ক্ষতিকর পোকা মাকড় মারে না, এর ব্যবহারে উপকারী পোকা ও মাকড়সাও মারা যায়। এছাড়া বালাইনাশক মানুষের জন্যেও নিরাপদ নয়। এসব রাসায়নিক পদার্থ মানুষকে রোগাক্রান্ত করে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বালাইনাশকের বিষাক্ততার কিছু অংশ উৎপাদিত ফসল ও খাদ্যের মধ্যে থেকে যায়। এছাড়া বালাইনাশকের দ্বারা পুকুর ও নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে জলজ প্রাণীর জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। বাতাস দূষিত করে। মাটির অনুজৈবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটায়।

বালাইনাশক ব্যবহারের পূর্ব সতর্কতা
সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন, ঝুঁকি হ্রাস বিষয়সমূহ যা অন্তর্ভূক্ত থাকবে ব্যবহারের পূর্বে সতর্কতা সঠিক বালাইনাশক নির্বাচন, তীব্র বিষ পরিহার, মেয়াদ উত্তীর্ণ বালাইনাশক না কেনা ও ব্যবহার না করা, খাদ্যদ্রব্যের সাথে বালাইনাশক বহন না করা। ভাঙ্গা/ খোলা বালাইনাশক কেনা যাবে না। বালাইনাশক নিরাপদ স্থানে শিশুদের নাগালের বাইরে রাখা। ব্যবহারের সময় সতর্কতা  বোতলের গায়ে লিখিত তথ্য/লেবেল পড়া, উপযুক্ত পোষাক পরা  শিশু ও গবাদিপশু হাঁস-মুরগি দূরে রাখা। খুলে গন্ধ না শোকা, মাত্রা মতো মিশানো।,

বালাইনাশক ব্যবহারকালীন সতর্কতা
ছিটানো/ব্যবহারের সময় ফুটো/ভাঙ্গা স্প্রেয়ার ব্যবহার না করা। মুখ দিয়ে বোতল না খোলা। খালি গায়ে স্প্রে না করা। খালি পেটে স্প্রে না করা। বাতাসের বিপরীতে না ছিটানো, স্প্রের সময় কিছু না খাওয়া। প্রখর রৌদ্রে স্প্রে না করা।বৃষ্টির পূর্বে এবং পরে স্প্রে না করা।

বালাইনাশক ব্যবহারের পরবর্তী সতর্কতা
ব্যবহারের পর সতর্কতা  ব্যবহারের পর খালি বোতল/ অবশিষ্ট বালাইনাশক মাটিতে পুঁতে ফেলা,  তোলা পানি দিয়ে অথবা টিউবওয়েলের পাশে স্প্রে মেশিন ভাল করে ধুয়ে রাখা,  নিজে সাবান দিয়ে ভাল করে গোসল করা, ব্যবহারকালীন পোষাক ধুয়ে ফেলা,  অবশিষ্ট বালাইনাশক নিরাপদ স্থানে রাখা,

বালাইনাশক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব
বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব  বালাইয়ের বালাইনাশকের প্রতি সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়। মানব স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।গবাদিপশু হাঁস মুরগি ও মাছের ক্ষতি হয়।উপকারী পোকা মাকড় ও জীব মারা যায়। পোকামাকড়ের পুনরুৎপত্তি হয়। মাটির অণুজীব মারা যায়। খাদ্যে বিষক্রিয়া হয়। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়, দূষিত হয়। বালাইনাশকের অবশেষ ক্রিয়া দীর্ঘদিন থাকে।

বালাইনাশকের ক্রিয়ায় আক্রান্ত মানুষের লক্ষণ ও ক্ষতি মাথা ঘোরা, ঘাম হওয়া, শ্বাস কষ্ট, দম বন্ধ হয়ে আসা, চোখ পিট পিট করা, চোখ থেকে পানি পড়া, রক্ত স্বল্পতা, ঝাপসা দেখা, লালা ঝরা, দ্রুত হৃৎকম্পন, উচ্চ রক্তচাপ, বমি হওয়া, ডায়ারিয়া, হাত পা ঝিন ঝিন করা, মাংস পেশীর টান, হাত পা ভেঙ্গে আসা, অজ্ঞান ও পরিশেষে মৃত্যু।

উপসংহার:
এছাড়া সমন্বিত পদ্ধতিতে পোকা ও রোগ দমনের সহজ প্রাপ্য পদ্ধতি সমূহের সমন্বয় করা হয় এবং গাছের বৃদ্ধির কোন পর্যায়ে কোন পোকা ও কোন অংশে কোন পোকা বা রোগ আক্রমন করে তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিলে বালাইয়ের আক্রমন হার সর্বনিম্ন থাকে এবং ফসলের উৎপাদন আর্থিকভাবে ক্ষতিকর হয় না। শক্রুপোকার সংখ্যা কমিয়ে/নিয়ন্ত্রণে রাখা। উপকারি পোকা-মাকড়ের সংখ্যা বাড়ানো। উৎপাদন খরচ কমিয়ে রাখা। কীটনাশকের ব্যবহার কমানো। পরিবেশের ভারসাম্য রজায় রাখা।

পোকার সমন্বিত ব্যবস্থাপনা সমূহ: জৈবিক ব্যবস্থাপনা- উপকারী পোকামাকড়ের বংশ বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য জমিতে এলোপাতারি বালাইনাশক ব্যবহার না করা,বালাই সহনশীল জাতের আবাদ,আধুনিক চাষাবাদ,যান্ত্রিক পদ্ধতি,বালাইনাশক ব্যবহার- অপকারিপোকার আক্রমন বেশি হলে-
(ক) সঠিক বালাইনাশক খ) সঠিক মাত্রা গ) সঠিক পদ্ধতি ও ঘ) সঠিক সময় মেনে, সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসাবে উদ্ভিজ্জ-নিমতৈল, নিমবীজের শ্বাসের চূর্ণ, নিশিন্ধা, বিষকাটালী, মেহগনীর বীজ, পাট বীজ, তামাক পাতা।কম স্থায়ী, স্পর্শ বিষ ব্যবহার করতে হবে। কীটনাশক শুধু ক্ষতিকর পোকা মাকড় মারে না, এর ব্যবহারে উপকারী পোকা ও মাকড়সাও মারা যায়। এছাড়া বালাইনাশক মানুষের জন্যেও নিরাপদ নয়। এসব রাসায়নিক পদার্থ মানুষকে রোগাক্রান্ত করে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি বালাইনাশকের বিষাক্ততার কিছু অংশ উৎপাদিত ফসল ও খাদ্যের মধ্যে থেকে যায়। এছাড়া বালাইনাশকের দ্বারা পুকুর ও নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে জলজ প্রাণীর জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। বাতাস দূষিত করে। মাটির অনুজৈবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটায়।

আইপিএমের আলোকে ফসলের, বসতবাড়ির সবজির ও ক্ষতিকর পোকা ও রোগর ব্যবস্থাপনা নিলে বালাইয়ের আক্রমন হার সর্বনিম্ন থাকে এবং ফসলের উৎপাদন আর্থিকভাবে ক্ষতিকর হয় না এবং নিরাপদ কৃষি উৎপাদন সম্ভব।
লেখক:উপপরিচালক (এল.আর)
সংযুক্ত উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা।
ইমইেল:This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.