খড় প্রক্রিয়াজাতকরণ:গবেষণায় সফলতা, ব্যর্থতা এবং উপযোগীতা

প্রফেসর ড. খান মো: সাইফুল ইসলাম:আমরা দারিদ্রের দুষ্টু চক্র সম্পর্কে সবাই অবগত আছি। দরিদ্র মানুষ দরিদ্র থাকার কারনে দারিদ্রের বলয় থেকে বের হতে পারে না। নতুন কোন কিছু গ্রহন করার মনস্তাত্বিক ক্ষমতা থাকে না বলে তারা দরিদ্র থেকে যায়। বিষয়টি যেমন একজন দরিদ্র ব্যক্তি ও দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য প্রযোজ্য, তেমনি একটি জাতির জন্যও প্রযোজ্য। এমনকি একটি জাতির উন্নয়নের জন্য যে সকল সেক্টর জড়িত সে সকল সেক্টরের সাথে সম্পর্কিত মানুষের জন্যও প্রযোজ্য। আশির দশক থেকে অদ্যাবধি প্রায় চল্লিশ বছর শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারন কর্মকান্ডে ব্যাপক মেধা ও অর্থ ব্যয় করা হয়েছে যাতে খড়ের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। সফলতা-ব্যর্থতার বিষয়টি এবার মিলিয়ে দেখা যাক।  

একসময় বাংলাদেশের প্রায় সব জমিতেই ধান চাষ করা হত। কারন, ভাত এদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। মানুষ তীব্র ঝালের শুটকি কিংবা ভর্তা দিয়ে এক গামলা করে ভাত খেত তিন বেলা। তাই বলা হতো ভেতো বাঙ্গালী। চালের মূল্য বৃদ্ধি পেলে জনমনে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা তৈরী হত। পত্র পত্রিকার হেডলাইন হত। তখন চালের বাজারদর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সূচক বলে বিবেচিত হত। অভ্যাসগত কারনে কেউ গবাদিপশুর খাদ্য উৎপাদনের জন্য কোন জমি ব্যবহার করত না। গবাদিপশু ছিল অবহেলিত। পশু, গরু, ছাগল, ভেড়া, গাধা, বলদ, শুকর এসব গালাগালি বলে বিবেচনা করাই প্রমান করে যে, আমরা কতটা অবহেলা করতাম এদের। বিষয়টি সমগ্র উপমহাদেশের জন্য প্রায় সমান ভাবে প্রযোজ্য। তাই মাড়াইকৃত ধানের খড়ই ছিল গবাদিপশুর প্রধান খাবার।

পুষ্টি বিবেচনায় এই খড়কে আদর্শ গো-খাদ্য বললে ভুল হবে। অধিক মাত্রার আঁশ (সেলুলোজ, হেমিসেলুলোজ), অপরিপ্রাচ্য আঁশ (লিগনিন) এবং সিলিকার উপস্থিতি খড়কে নিন্মমানের গোখাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা হত। যেহেতু অধিকাংশ গাভী কম উৎপাদনশীল ছিল তাই এই নিম্নমানের খাদ্যে লালন পালন করা হত গবাদিপশু। আলাদা কোন খাদ্য উৎপাদনের জন্য চিন্তা করা হত না। এখনও খড়ই এদেশের গবাদিপশুর প্রধান খাদ্য, বিশেষ করে কম উৎপাদনশীল গবাদিপশুর জন্য। শুধু তাই নয় জাত উন্নয়ন করা হলেও অভ্যাসগত কারনে ঐসব গবাদিপশুকেও এই নিম্নমানের খড় খাওয়াচ্ছে অনেক কৃষক। ফলে জাতগত ভাবে বেশী উৎপাদনশীল হলেও কার্যত কম উৎপাদন দিচ্ছে ওইসকল গবাদিপশু।   

একটা সময় মানুষ গবাদিপশুর গুরুত্ব অনুধাবন করা শুরু করল। মানুষ জানত যে, ’গরুর মুখে দিলে ঘাস, দুধ পাবে বার মাস’। কিন্তু ঘাস চাষের জন্য জমি কোথায় ? কেনই বা ঘাস চাষের জন্য জমি ব্যবহার করবে। গরু তো দুধ দেয় অনেক কম। প্রায় এক-দেড় লিটার। গবেষকগন ভাবতে শুরু করল কিভাবে খড়ের পুষ্টিমান বাড়ানো যায়। আর তাই গত আশির দশকে বিজ্ঞানীগন লাগসই প্রযুক্তি হিসেবে খড়ের পুষ্টিমান বাড়ানোর জন্য গবেষনা শুরু করেন। খড়কে ইউরিয়া আর মোলাসেস দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কৌশল অনুসরন করেন। কখনো কখনো ক্ষার, বিশেষ করে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। দেখানো হয় বিভিন্ন ধরনের সুফল। দেশী-বিদেশী জার্নালে আর আন্তর্জাতিক সেমিনারে গবেষণার ফলাফল প্রদর্শিত হয়। দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানসমূহে বড়বড় প্রকল্প হাতে নেয়। সে এক বিশাল গবেষণা কর্মকান্ড। পরবর্তী প্রজন্মকে শেখানো হয় এই সকল প্রযুুক্তি। আর তাই ২০২১ সালেও কোন কোন গবেষক প্রক্রিয়াজাতকরন নিয়ে আশাবাদি।

আনুমানিক ২০০০ সালের কথা। একটি গবেষনায় দেখা যায় যে প্রক্রিয়াজকৃত খড় খাওয়ানোর ফলে গাভীর দুধ উৎপাদন ১.৫ লিটারের স্থানে ১.৭ লিটারে উন্নীত হয়। আমার প্রশ্ন ছিল যদি দেশের সকল গাভীকে প্রক্রিয়াজাতকৃত খড় খাওয়ানো হয় তবে দেশের দুধ উৎপাদন কি পরিমান বাড়বে ? এম.এস.এর ছাত্র উত্তর দিতে পারেনি। বরং তার গবেষনা তত্বাবধায়ক কিছুটা নাখোশ হয়েছিলেন। তখন বিজ্ঞানীগন খড় নিয়ে এত বেশী আবেগপ্রবন ছিলেন যে, এসকল গবেষনার প্রভাব পড়েছিল অন্যান্য ধান উৎপাদনশীল দেশ সমূহে। বিদেশী পাঠ্যপুস্তকে খড় প্রক্রিয়াজাত নিয়ে আলাদা অধ্যায় লেখা শুরু করল। যেখানে বাংলাদেশের সফলতার কথা লেখা থাকত। গর্বে বুক উচু হয়ে যেত। কিন্তু আজ ২০২১ সালে এসে ওই সমস্ত অংশ বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কেন?

আমরা জামা বানাই শরীরের মাপে। জামার মাপে শরীর বানাই না। খড় প্রক্রিয়াজাতকরন তেমনি জামার মাপে শরীর বানানোর মতো। আমাদের জমি নাই তাই খড়ই ভরসা। আমাদের অনেক খড় আছে তাই আমরা কিভাবে ব্যবহার করব তা নিয়ে ভেবেছি। কখনো ভাবিনি কৃষক খড় প্রক্রিয়াজাত পদ্ধতি অনুসরন করবে কিনা। যে গাভী মাত্র ১.৫ লিাটর দুধ দেয় তার জন্য কৃষক কেন এত জটিলতম কাজ করবে? এছাড়া প্রক্রিয়াজাতকৃত খড় খাওয়ালে দুধের পরিমান যদি সামান্য বৃদ্ধি পায় তবে তো তেমন লাভ হবে না কৃষকের। বিজ্ঞানীরা সম্প্রসারন কর্মকান্ডে ব্যাপক বিনিয়োগ করার পরও কৃষক তার গবাদিপশুকে প্রক্রিয়াজাত খড় খাওয়াতে অভ্যস্ত হয়নি। শুধু তাই নয়, অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। উচ্চ ফলনশীল ধানের খড়ের পুষ্টিমান আরও কমে গেছে। উচ্চ ফলনশীল ধানের গাছ অপেক্ষাকৃত শক্ত হওয়ার কারনে খড় আরও নিম্নমানের হয়। এছাড়া গাছের দৈর্ঘ্য ছোট হওয়ার কারনে দেশে খড়ের মোট উৎপাদনও কমে গেছে। আর তাই আমাদের ভাতের মতই আজ খড়ের দাম অনেক বেশী। কেবল অভ্যাসগত কারনে, পুষ্টিগত কারনে নয়। তদুপরি খড় গাদা করে সংরক্ষন করা হলে যে সামান্য পুষ্টিমান রয়েছে তাও কমে গিয়ে শূন্যের কোঠায় পৌঁছায়। ফলে খড়ের উপর ভরসা করলে কখনোই আশানুরুপ উৎপাদন পাওয়া যাবে না।

আশির দশক থেকে অদ্যাবধি প্রায় চল্লিশ বছর শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারন কর্মকান্ডে ব্যাপক মেধা ও অর্থ ব্যয় করা হয়েছে যাতে খড়ের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু সঙ্গত কারনে এই প্রক্রিয়াজাতকৃত খড়ের কদর বাড়েনি। কম উৎপাদনশীল গাভীর খাদ্য হিসেবেও খড় উপযোগীতা হারিয়েছে। উচ্চ উৎপাদনশীল গাভীর জন্য চিন্তাই করা যায় না। তবে এত মেধা, অর্থ আর সময় ব্যয় করে কি লাভ হল। যদি আশির দশকেই অন্য খাতে গবেষনা পরিচালিত করা তবে এই খাত হয়ত আরও এগিয়ে যেত।

আমরা দারিদ্রের দুষ্টু চক্রে আবদ্ধ বিধায় একটি নির্ধারিত গন্ডির বাইরে ভাবতে পারিনা। যা আবশ্যকীয় তার জন্য আমরা এখন থেকেই পরিকল্পনা করিনা। যদিও ভাবি আমাদের মত করে ভাবি, যদিও পরিকল্পনা করি আমাদের মত করে করি। ফলে উন্নয়নের জন্য যে সকল ধাপ অতিক্রম করি তাতে অনেক ক্রটি থেকে যায়। আবার সেসকল ক্রুটি দুরীকরণে ব্যয় করতে হয় অনেক মেধা, অর্থ ও সময় যা আমাদেরকে অনেক পিছিয়ে রাখে। অর্থাৎ আমরা অনুন্নত হওয়ার কারনেই উন্নত ভাবনা ভাবতে পারিনা বলেই আমরা অনুন্নত থেকে যাই। অনেক সময় লাগসই প্রযুক্তির নামে আমরা যা করি তা টেকসই হয় না। বরং বেশ কিছু সময়, মেধা আর অর্থ ব্যয় হয়।

আশির দশকে আমরা ভাবতে পরিনি যে, খড় কেবল মাত্র কম উৎপাদনশীল গবাদির খাদ্য হিসেবেই প্রযোজ্য, খড়ের পুষ্টিমান আরও কমবে, প্রক্রিয়াজাতকরন পুষ্টিমানে প্রভাব ফেলছে অতি সামান্য, প্রক্রিয়াজাতকরনে খামারীর আগ্রহ অনেক কম। এ সকল যৌক্তিক কারন উপেক্ষা করেই গবেষণা চালিয়ে গেছেন অনেকে। এই পদ্ধতির উপর বিশ্বাস স্থাপন করে যুগ যুগ ধরে গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছেন নতুন প্রজন্মের গবেষকগন। আমরা যদি সত্যিকারের উন্নয়ন চাই তাহলে এধরনের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে উদ্দেশ্য অনুযায়ী গতানুগতিক ধারা বাদ দিয়ে পরিকল্পনা প্রনয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে খড় প্রক্রিয়াজাতকরন একটি উদাহরন মাত্র। সকল ক্ষেত্রেই এই উদাহরন প্রযোজ্য। উচ্চ উৎপাদনশীল গবাদিপশুর সংখ্যা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। তাই এক সময় গবেষকগন জাত উন্নয়নে কাজ শুরু করল। এটিও সত্য যে, উন্নত জাতের গবাদিপশুর সঠিক উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য সবুজ ঘাস আবশ্যক।

আজ গবাদিপশু উন্নয়নের যে সম্ভাবনা দৃশ্যমান তা গবাদিপশুর জাত উন্নয়নের মাধ্যমে হয়েছে। অধিকাংশ জমি মানুষের খাদ্য উৎপাদনের জন্য ব্যয় হলেও কেউ কেউ ঘাস চাষও করছে। সরকার সহ বিভিন্ন সংস্থা এসকল কাজে এগিয়ে আসছে। যে সম্ভাবনা আজ দেখা দিচ্ছে তা আরও আগে দেখা যেত। তাই আসুন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে চিন্তাভাবনার যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা নিরুপন করি এবং পরিকল্পনা প্রনয়নে সঠিক সিদ্ধান্ত নেই।

গবাদিপশুর জন্য পর্যাপ্ত ঘাস উৎপাদন করি। গবাদিপশুও আমাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমান দুধ ও মাংসের যোগান দিবে। শুধু তাই নয় আমরা পাব মান সম্মত দুধ ও মাংস এবং বিভিন্ন উপজাত যা নির্বিঘ্নে নিরাপদ বলে খেতে পারব।

লেখক:প্রফেসর
পশু পুষ্টি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.