ডেয়রী উন্নয়নে ভোক্তা সৃষ্টি আবশ্যক

প্রফেসর ড. খান মো: সাইফুল ইসলাম: মুরব্বীগণ গর্ব করে বলে থাকেন “একসময় গোলাভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু ছিল এদেশে ”। কথাটি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় যে তখন ধান চাষের জন্য অধিকাংশ জমি ব্যবহার করা হতো | আর ধান মাড়াইয়ের পর যে খড় পাওয়া যেত তাই ছিল গো-খাদ্য। যা গবাদিপশুর প্রধান খাদ্য ছিল। একদিকে বাঙ্গালীর খাদ্যাভ্যাসে ছিল শর্করার আধিক্য | অন্যদিকে গবাদিপশুর খাদ্যে ছিল খড়ের আধিক্য। নিম্নমানের খাদ্যগ্রহনে অভ্যস্ত গবাদিপশু ছিল খুব কম উৎপাদনশীল। হাজার বছর ধরেই এই অঞ্চলের গবাদিপশুর কম উৎপাদনশীলতা আর নিম্নমানের খাদ্যগ্রহন পরিপুরক। অনেক পূর্ব থেকেই খুব কম গাভীই ১.৫ লিটারের বেশী দুধ দিত। তখন মাথাপিছু দুধ পানের পরিমান ছিল ৫০ মি.লি-এরও কম। যেখানে বলা হয় সুস্থ সবল থাকার জন্য মাথাপিছু প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ২৫০ মি.লি দুধ পান আবশ্যক।

যেহেতু দুধ পান না করলে এর অভাবজনিত কোন প্রভাব সরাসরি দৃশ্যমান হয় না এবং যেহেতু এদেশের মানুষ যথেষ্ট শিক্ষিত ও সচেতন ছিল না সেহেতু দুধ পান করতে না পারলেও তাদের মধ্যে তেমন কোন চাহিদা পরিলক্ষিত হয়নি। তাই ২৫০ মিলি দুধের প্রাপ্যতাকে আমরা প্রয়োজনীয়তা বললেও চাহিদা বলতে পারিনা। তবে এটি সত্য যে, দেশের সকল মানুষের সুস্থতা ও মেধা বিকাশের জন্য মাথাপিছু যে পরিমান দুধের প্রয়োজন তার চাহিদা তৈরী করতে হবে। তা না হলে দুগ্ধ উৎপাদনে খামারীরা নিরূৎসাহিত হবে এবং আমরা সুস্থ সবল মেধাবী জাতি থেকে বঞ্চিত হব।

বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। তাদের সাথে সাক্ষাত করে জানা যায় যে,  যদি তারা সচ্ছল হন কিংবা যথেষ্ট অর্থের মালিক হন তবে তারা কি কি খাদ্য বেশী খাবেন। তাদের অধিকাংশই দুধের কথা বলত না। কারণ তারা দুধ খেতে অভ্যস্থ নয়। তবে বর্তমানে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন চায়ের দোকানে আলাপ করে দেখা গেছে যে, তারা কৃত্রিম কনডেন্সড/ঘন দুধ দিয়ে চা পানে অভ্যস্থ, সেখানে গরুর দুধ দিয়ে চা বানালে তারা পছন্দ করে না। এমনটি হয়েছে কেবলমাত্র অপ্রতুলতা জনিত অভ্যাসগত কারনে।  

সকল বিবেচনায় দেখা যায় যে, অনাদিকাল থেকে দুধের প্রাপ্যতা না থাকার কারণে সাধারণ মানুষের দুধ পানের প্রতি আগ্রহ কম ছিল কিংবা অভ্যস্ত ছিল না, ফলে দুধকে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য/পানীয় হিসেবে বিবেচনা করেনি। যদিও কেবল দুধই একমাত্র খাদ্য/পানীয় যাতে কোনও প্রানীর দৈহিক বৃদ্ধির জন্য সকল অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদান বিদ্যমান।

দুধের চাহিদা তৈরী না হওয়ায় কারনে সহজেই একজন খামারী তার খামারে উৎপাদিত দুধ বিক্রি করতে পারে না। এছাড়া দুধ পচনশীল বিধায় এবং খুব সীমিত আকারে দুগ্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠিত হবার কারনে সরবরাহ প্রক্রিয়া সামান্য ব্যাহত হলেই দুধ নদীতে ঢেলে ফেলার মত ঘটনাও ঘটে। কারন অভ্যাস নাথাকার কারনে স্থানীয় পর্যায়ে চাহিদার অনুপস্থিতি বিদ্যমান।

এমতাবস্থায় জনগনের মধ্যে দুধ পানের ব্যাপক চাহিদা তৈরী করা আবশ্যক। এর পাশাপাশি উৎপাদিত দুধের প্রক্রিয়াজাতসহ বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করতে হবে। কথাটি সহজে বলে ফেললেও কাজটি সহজ নয়। কারণ গাভীর উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি, উন্নত গোখাদ্য নিশ্চিতকরণ, বিভিন্ন আকারের দুগ্ধশিল্প স্থাপন, দুগ্ধজাত দ্রব্য বিপনন ইত্যাদি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। অন্যভাবে বলা যায় যে, কাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখব না যে সকল মানুষ মেপে মেপে ২৫০ মি.লি দুধ পানের জন্য পাগল। যা ৯০ বছরেও হয়নি তা ৯ বছরে হবে না। তাহলে কত বছর লাগবে? বলা মুশকিল, তবে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে।

স্কুল ফিডিং একটি কার্য্যকরী প্রক্রিয়া। ছাত্র-ছাত্রীকে টিফিনে দুধ-পান বাধ্যতামূলক করে দেয়া যেতে পারে। কারণ অভ্যাস ছোট বেলা থেকেই গড়ে ওঠে। যেহেতু ডেয়রী উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া তাই স্কুল ফিডিং ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে এক সময় জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ দুধ পানে অভ্যস্ত হবে। খামারীরা ধীরে ধীরে উৎপাদনশীল গবাদিপশু পালনে আগ্রহী হবে। কৃষিতে অন্যান্য পন্যের সাথে দুধ উৎপাদনের একটি সাম্যাবস্থা তৈরী হবে।

স্কুল ফিডিংয়ের পাশাপাশি ছোট ছোট কারখানায় বিভিন্ন ধরনের দুগ্ধজাত দ্রব্য (বাটার, ঘি, বিভিন্ন ধরনের পনির, বিবিন্ন ধরনের দুগ্ধজাত পানীয় ইত্যাদি) তৈরী করা উৎসাহিত করতে হবে। ফলে জনগন ধীরে ধীরে ঐ সকল দুগ্ধজাত দ্রব্য গ্রহনে অভ্যস্ত হবে। বর্তমানে ঐ সকল দুগ্ধজাত দ্রব্য পর্যাপ্ত না থাকার কারণে মানুষ ওসবে অভ্যস্ত নয়। হিসেব করলেই বুঝতে পারা যায় যে, ক-জন মানুষ পনির খেতে অভ্যস্ত। পর্যাপ্ত পরিমান সরবরাহ করলেও অধিকাংশ মানুষ অভ্যস্ত না থাকার কারনে খাবে না। অথচ উন্নত দেশে কেবল নানারকমের পনিরের জন্য রয়েছে আলাদা দোকান। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও চাহিদা তৈরী হয়নি।

এমতাবস্থায় ভোক্তা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক কার্য্যক্রম হাতে নিতে হবে। তবে বর্তমান সময়ে যে পরিমাণ দুধ উৎপাদন হয় তা ব্যাপক কার্য্যক্রম হাতে নেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। সেক্ষেত্রে কঠিন শর্তসাপেক্ষে গুড়া দুধ আমদানী করে নতুন নতুন ডেয়রী প্রোডাক্ট তৈরী করার জন্য ব্যবহার করতে হবে। ভোক্তা সৃষ্টির জন্য এটি আবশ্যক। দেশীয় দুগ্ধ শিল্প বিকশিত করতে হলে শিল্পের মাধ্যমে দুধের বিপনন নিশ্চিত করতে হবে। এটি কি বর্তমানে সম্ভব হচ্ছে? ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য শিল্প পর্যায়ে ব্যাপক প্রক্রিয়াজাত ও বিপনন আবশ্যক। দুগ্ধজাত দ্রব্যের সিংহভাগই আমদানীকৃত এবং ভোক্তা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে।

ভোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমেই দুধের চাহিদা তৈরী করা সম্ভব। তবে ভোক্তা বৃদ্ধির পাশাপাশি চাহিদা বৃদ্ধি এবং দেশীয় দুগ্ধ উৎপাদন সামঞ্জস্য রেখে দুধ আমদানী নিয়ন্ত্রন করতে হবে। ভোক্তা ও চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি ডেয়রী উন্নয়নের কর্মকান্ড পরিচালিত হলে একসময় মাথাপিছু দুধের প্রয়োজনীয়তা মিটবে। ফলে আমরা পাব সুস্থ সবল মেধাবী জাতি। আসুন নিজে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি। অন্যকে দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য পরিবেশনসহ দুধ পানে উৎসাহিত করি।

লেখক:প্রফেসর
পশু পুষ্টি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.