বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা

ড. মোঃ আবদুছ ছালাম:সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ১৮ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বলেছিলেন “স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলাম; আজ স্বাধীনতা পেয়েছি। সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছি; সোনার বাংলা দেখে আমি মরতে চাই”। বঙ্গবন্ধুর সেই ইচ্ছা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট কালো রাত্রিতে তাঁকে স্বপরিবারে হত্যার মাধ্যমে ভূলণ্ঠিত করেছিল কুচক্রী মহল। স্বাধীনতা পরবর্তী ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে ৩১৮ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে ১০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন কৃষি খাতে যা উন্নয়ন বাজেটের ৩২.৩৯ শতাংশ। বাংলাদেশ আজ তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্ব দরবারে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে ২০২১-২২ অর্থ বছরে বাংলাদেশ আজ ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে, যেখানে কৃষিখাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ৩১ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা যা মূল বাজেটের ৫.৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেটের আকার বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বাজেটের তুলনায় ৭.৬৮ গুন বড়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কৃষি খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়লেও কমেছে বরাদ্দের হার। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের মোট খাদ্য উৎপাদন ছিল প্রায় ১০ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা বর্তমানে প্রায় ৪১ মিলিয়ন মেট্রিক টন, অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদন প্রায় ৪ গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিখাতে এ ঈর্ষনীয় সাফল্যের অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারের কৃষি বান্ধব নীতি, কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলসভাবে কাজ করে উচ্চফলনশীল, খরা, লবণাক্ততা, জল মগ্নতা সহিষ্ণু, স্বল্প জীবনকাল ও পুষ্টিসমৃদ্ধ বিভিন্ন ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণবিদদের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ।

বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, আলু উৎপাদনে সপ্তম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয় এবং চা উৎপাদনে চতুর্থ স্থান অর্জনকারী দেশ। অপর দিকে স্বাধীনতাকালীন সময়ে এদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি যা বর্তমানে দ্বিগুনের চেয়ে কিছুটা বেশী। মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ১৯৭১ সালে ২৮ শতাংশ যা কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশ এবং আবাদি জমির পরিমাণ কমছে ০.৭৩% হারে। ২০০১ সালে দেশে ৪০ লাখ টন খাদ্য শস্য উদ্বৃত্ত হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘সেরেস’ পদকে ভূষিত করেন। সত্যিই দেশ আজ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই জাতির পিতা যথার্থই বলেছিলেন- “আমরা কেন অন্যের কাছে খাদ্য ভিক্ষা চাইব। আমাদের উর্বর জমি, আমাদের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজে সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করব। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার”।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৫ সালে চাল, গম, ভূট্টা এবং সবজি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে যথাক্রমে ৪১.৭৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন, ১.৪৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন, ৬.৮৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং ২৩.৯৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে অর্জিত হয়েছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। দেশের জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩.৬১ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থ বছরে দেশে মৎস্য উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। আর ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৫ সালে উৎপাদনের টার্গেট ধরা হয়েছে ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার দ্যা স্টেট অব ওয়াল্ড ফিশারিজ এন্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে অভ্যন্তরীন মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। মাথাপিছু আমাদের মাছের উৎপাদন হচ্ছে ৬২ গ্রাম/দিন, অপর দিকে মাথাপিছু চাহিদা হচ্ছে ৬০ গ্রাম/দিন। দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদাপূরণে প্রাণিসম্পদের ভূমিকা অপরিসীম। জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের অবদান ৩.৪৭ শতাংশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে দেশীয় গরুর জাত উন্নয়নের জন্য প্রথম কৃত্রিম প্রজননের ব্যবস্থা করেন, যা আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও অব্যাহত রয়েছে। আমাদের মাথাপিছু মাংসের উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ১২৫ গ্রাম/দিন, আর চাহিদা হচ্ছে ১২০ গ্রাম/দিন; ডিমের উৎপাদন হচ্ছে মাথাপিছু প্রায় ১০৫টি/বৎসর, আর চাহিদা হচ্ছে ১০৪টি/বৎসর; দুধের উৎপাদন হচ্ছে ১৭৫ মিলি/দিন আর চাহিদা হচ্ছে ২৫০ মিলি/দিন। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৫ সালে দুধ, মাংস এবং ডিম উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে যথাক্রমে ১৬.৩৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন, ৮.৫১ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং ২২৩৯৩ মিলিয়ন। বর্তমানে আমরা মাংস এবং ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এছাড়া বাংলাদেশ আজ বিদেশে মাংস রপ্তানী করছে।

১৯৯২ সালে দেশে দারিদ্র্যতার হার ছিল ৫৭ শতাংশ যা ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়ে ছিল প্রায় ২০ শতাংশে। বর্তমানে যা বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর কারণে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আশির দশকে দেশে জন্মহার ছিল ৬ শতাংশ যা বর্তমানে ১.১ শতাংশ। ১৯৭১ সালে দেশে শিক্ষার হার ছিল ১৮%, যা বর্তমানে প্রায় ৭৫ শতাংশ। মানুষের বর্তমানে গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর যা ১৯৭২ সালে ছিল ৪৭ বছর।

২০২০-২১ অর্থ বছরে মাথাপিছু আয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার হয়েছে। আর পাকিস্তানকে অনেক আগেই আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। ১৯৭২-৭৩ সালে আমাদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ছিল ৮৮ মার্কিন ডলার যা ৬৭৬ টাকা। সে হিসেবে মাথাপিছু দৈনিক আয় ছিল ১ টাকা ৮৫ পয়সা, যা বর্তমানে ৫২৫ টাকা। অর্থাৎ বর্তমানে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ শতাংশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ বর্তমানে ৪৩ তম অর্থনৈতিক দেশ এবং দ্রুত বর্ধনশীল দেশসমূহের মধ্যে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। ২০১৯-২০ সালে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ ছিল ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থ বছরে বেড়ে হয়েছে ৩০ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এসডিজিসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় সাফল্য দেখে আজ পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনোমিক্স এন্ড বিজনেস রিসার্চ (CEBR) এর রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশ ২০৩২ সালের মধ্যে বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের মধ্যে ২৪ তম হবে। ২০৩৩ সালের মধ্যে সিঙ্গাঁপুর, মালেশিয়া, সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ডকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। ১৯৭০ সালে নির্বাচনী ইসতেহারে যমুনা এবং পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল, যা বর্তমানে বাংলার জনগণ যমুনা সেতুর সুফল ভোগ করছে এবং অচিরেই পদ্মা সেতুর সুফল ভোগ করবে।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডেভিড ব্রিউস্টার বলেছেন, বাংলাদেশ তার আঞ্চলিক শক্তি দেখাতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ এক সময়ে বিদেশী সাহায্য নির্ভর দেশ ছিল। আজ বাংলাদেশ দাতা দেশ হিসেবে শ্রীলন্কাকে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তামূলক ঋণ দিচ্ছে।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ও প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল প্রায় ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে টার্গেট ধরা হয়েছে ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশে বর্তমানে অর্থনৈতিক সহনশীলতা রয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় ২০৪৭ সালে মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার।

বর্তমান সরকারের ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’-এ প্রতিশ্রুত অন্যতম উদ্দেশ্য ও অঙ্গীকার ‘সবার জন্য পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধান’। এ লক্ষ্যে বর্তমান সরকার প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ এবং ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ প্রণয়ন করেছে। কৃষি, কৃষক এবং গ্রামীন অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য প্রণীত পলিসি’র ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) কৌশল অনুসরণের ধারা অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আলোকবর্তিকা তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে আমরা এসডিজি অর্জনের মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে গড়ে তুলব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত সমৃদ্ধ ও শান্তির সোনার বাংলা।

লেখক পরিচিতি: সদস্য পরিচালক (পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল