কম্বাইন হারভেস্টার: মওসুম শেষে রক্ষণাবেক্ষণে করণীয়

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

ড. মো. আনোয়ার হোসেন:কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বাংলাদেশ নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। কিছুদিন আগেও যেখানে জমি চাষ, সেচ এবং শস্য মাড়ায়ে যন্ত্রপাতির ব্যবহার ছিল, আজ সেখানে যুক্ত হয়েছে আধুনিক মানের ট্রাক্টর, কম্বাইন হারভেস্টার, রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারসহ আরও অনেক আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি। এক হিসাবে জানা যায় যে, বর্তমানে দেশে তিন হাজারেরও অধিক কম্বাইন হারভেস্টার কৃষক পর্যায়ে সফলতার সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে আগে ধান কাটতে শ্রমিক সংকটের সঙ্গে সময় এবং শস্যের অপচয় হতো, এখন সেখানে কম্বাইন হারভেস্টার মেশিনের সাহায্যে হেক্টরের পর হেক্টর জমির ধান কাটতে শ্রমিক মজুরির সঙ্গে সময় এবং শস্যের অপচয়ও রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। ফলশ্রূতিতে কৃষক এইবার বোরো মওসুমে নির্বিঘ্নে মাঠের ধান ঘড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। 

বোরো মওসুম প্রায় শেষ। আগামী আউশ বা আমনের আগে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারের সুযোগ নেই। অনেক দামী এবং মূল্যবান মেশিনটি দীর্ঘ সময় অব্যবহৃত থাকবে। এই দীর্ঘ অব্যবহৃত সময় কম্বাইন হারভেস্টর যন্ত্রটি যাতে ভালো থাকে এবং পরবর্তী মওসুমে দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা যায় তার জন্য এখনই প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি চেকলিস্ট নিম্নে দেয়া হলো।

১. বর্তমানে বাংলাদেশে হোল ফিড এবং হেড ফিড কম্বাইন হারভেস্টারের বিভিন্ন মডেল কৃষক পর্যায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিছু অংশ সকল মেশিনের জন্য একই হলেও মেশিনের মডেল ভেদে প্রার্থক্যও আছে। প্রথমে রক্ষণাবেক্ষণের চেক পয়েন্টের তালিকা নির্দিষ্ট মেশিনের ম্যানুয়াল অনুযায়ী প্রস্তুত এবং করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।  

২. মেশিনের বাহিরের এবং ভিতরের সকল কাঁদা, ময়লা, খড়, ধান বা আবর্জনা ভালোভাবে পরিস্কার করতে হবে। মেশিনের ভিতরের ধান, খড় বা ফসলের অবশিষ্ট অংশ সাধারণত ইঁদুরকে আকর্ষণ করে যা মেশিনের বৈদ্যুতিক তার, হাইড্রোলিক লাইন, সেন্সরের তার এমনকি প্লাস্টিকের বিভিন্ন অংশ কেটে মেশিনের ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে। রেডিয়েটর এবং অন্যান্য তাপ এক্সচেঞ্জারগুলিকেও ভালোভাবে পরিস্কার করে ইঁদুরের আক্রমণ হতে রক্ষা করতে হবে। তাছাড়া, ইঁদুর যাতে মেশিনের ভিতর প্রবেশ করতে না পারে বা মেশিনের কোন ক্ষতি করতে না পারে তার জন্য ইঁদুরকে বাধা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৩. মেশিনের শুধুমাত্র বাহিরের অংশগুলি পানি দিয়ে পরিস্কার করতে হবে। বিভিন্ন বিয়ারিং, চেইন-স্পোকেট এবং অন্যান্য চলন্ত অংশগুলিকে বৃষ্টি বা পানি হতে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করতে হবে। মেশিনকে অবশ্যই মেশিন শেডে রাখতে হবে। যাদের মেশিন শেড নেই তাদেরকে প্রয়োজনে অস্থায়ী শেড প্রস্তুত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বৃষ্টির পানি বা কূয়াশায় মেশিনের লোহার অংশে বা ক্রলারের হুইল বা শ্যাফটে মরিচা পরতে পারে।

৪. মেশিনের যেসব অংশে স্ক্র্যাচ পড়েছে বা রং নষ্ট হয়ে গেছে বা মেশিনের জীর্ণ অংশগুলি রং বা পেইন্ট করে সংরক্ষণ করতে হবে। একটু সময় বেশী লাগলেও মরিচার হাত থেকে মেশিন রক্ষা করার জন্য তা করা প্রয়োজন।

৫. মেশিনের বাহিরের কভারসমূহ খুলে থ্রেসিং ড্রামের কনকেভ এবং চালনিগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হবে এবং কোন সমস্যা থাকলে তা মেরামত করতে হবে অথবা পরিস্কার করতে হবে।

৬. মেশিনের বিভিন্ন শ্যাফটের বিয়ারিং পরীক্ষা করতে হবে। শ্যাফটের এলাইনমেন্ট বিচ্যুত হলে বা শিথিল হলে বিয়ারিং পরিবর্তন করে মেশিন সংরক্ষণ করতে হবে। অনেকেই মনে করে, পরবর্তী মওসুম শুরু হওয়ার আগে আগে বিয়ারিং পরিবর্তন করে মেশিন মাঠে নামাবে। তা ঠিক নয়। এতে করে মেশিনের শ্যাফট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

৭. মেশিনের সকল গ্রীস-ফিটিংগুলিতে গ্রীস বা অয়েল দেয়ার সময় বা তৈলাক্তকরণের সময় মেশিনের লুব্রিকেন্ট অয়েল ১৫০ ঘন্টা ব্যবহার হলে, গিয়ার অয়েল এবং হাইড্রোলিক অয়েল ৩০০ ঘন্টা ব্যবহার হলে পরিবর্তন করতে হবে। অনুরুপভাবে, ফুয়েল ফিল্টার ১৫০ ঘন্টার কম হলে পরিস্কার করে পুনরায় ব্যবহার এবং লুব্রিকেন্ট অয়েল ফিল্টার ৩০০ ঘন্টার কম হলে পরিস্কার করে পুররায় ব্যবহার করা যাবে। অন্যতায় ফিল্টারগুলো পরিবর্তন করতে হবে।

৮. সমস্ত লাইট পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং নিশ্চিত হতে হবে যে, সকল লাইট এবং সিগনাল সঠিকভাবে কাজ করছে। অন্যতায় বৈদ্যুতিক লাইন এবং লাইট মেরামত করে মেশিন সংরক্ষণ করতে হবে।

৯. কুলিং সিস্টেম পরিস্কার করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং ধারালো বা মেটালিক বস্তুর ব্যবহার পরিহার করতে হবে। রেডিয়েটর পরিস্কার এবং চেক করার পর ভালো কুলেন্ট অর্থাৎ পরিষ্কার আয়রণ মুক্ত পানি দ্বারা পূর্ণ করে রাখতে হবে। কোনভাবেই আয়রণ, লবণাক্ত বা ময়লাযুক্ত পানি ব্যবহার করা যাবে না।

১০. খড়সহ ধান, খড়, মাড়াইকৃত ধান এবং পরিস্কার ধান পরিবহণের সাথে সম্পৃক্ত সকল অগার (augers), পরিবাহক (Coveyors) এবং সংযুক্ত চেইন, বেল্ট বা গিয়ার পরিস্কার করতে হবে এবং প্রয়োজনে মেরামত বা পরিবর্তন করতে হবে।

১১. সমস্ত বেল্ট এবং বেল্টের টেনশন পরীক্ষা করতে হবে। বেল্টে কোন ফাটল বা ছেড়া থাকলে তা পরিবর্তন করতে হবে। তাছাড়া সংরক্ষণের সময় সমস্ত বেল্ট এবং চেইনের টেনশন কমিয়ে লুজ করে রাখতে হবে। সমস্ত চেইন এবং চেইন স্পোকেট পরিস্কার করে গ্রীজ বা লুব্রিকেন্ট দিয়ে রাখতে হবে। বিশেষ করে ফিডার হাউজের এবং ইলিভেটরের চেইন ভালোভাবে পরিস্কার করে রাখতে হবে। সর্বোপরি সমস্ত ফিটিং এবং লুব্রিকেট চেইন এবং অপারেটরের ম্যানুয়ালে বর্ণিত অন্যান্য রক্ষণাবেক্ষণ পয়েন্টগুলিতেও গ্রিজ করতে হবে। বেল্ট সমূহ আলগা করে শুকিয়ে একটি শুকনো এবং ঠান্ডা জায়গাতেও সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

১২. কম্বাইন হারভেস্টারের ক্রলার ইটের উপর বা পাঁকা মেঝেতে রাখতে হবে। সংরক্ষণের সময় ক্রলারের টেনশন কমিয়ে রাখতে হবে। এমনভাবে টেনশন কমাতে হবে যাতে ক্রলার এবং ক্রলারের হুইলের মধ্যে আনুমানিক ১০ মিমি গ্যাপ থাকে।

১৩. মাসে অন্তত ২ বার ইজ্ঞিন চালু করতে হবে এবং কাটার বার, থ্রেসার এবং কনভেয়ার জায়গায় রেখে (স্থির রেখে) আনুমানিক ১০ মিনিট মেশিন চালাতে হবে।

১৪. জ্বালানী ট্যাংক জ্বালানী দ্ভারা ভরাট করে রাখতে হবে।

১৫. মেশিনের চালনী আলাদা করে পরিষ্কারের পর সাবধানে এটি সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

১৬. ব্যাটারি সরিয়ে শুকনো ঘরে রাখতে হবে অথবা ব্যাটারির লাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হবে এবং প্রতি মাসে এটি চার্জ করতে হবে।

সঠিকভাবে কম্বাইন হারভেস্টার সংরক্ষণ করে নিজের এবং দেশের অর্থ সাশ্রয় করার মাধ্যমে টেকসই যান্ত্রিকীকরণ নিশ্চিত করা সম্ভব।

লেখক:ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এফএমপিএইচটি বিভাগ, ব্রি, গাজীপুর