"কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে মাটির স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে"

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

মোঃ হুমায়ন কবির:বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষি উৎপাদন বেড়েই চলছে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গিয়ে শস্যের নিবিড়তা বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু দিনদিন  মাটির উৎপাদনশীলতা ও উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। ফসল উৎপাদনের জন্য ভালো বীজ ও উত্তম ব্যবস্থাপনা যেমন প্রয়োজন তেমনি মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখার বিকল্প নেই। উপযুক্ত মাটি না হলে অর্থাৎ ফসলের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সমৃদ্ধ মাটি না হলে দীর্ঘমেয়াদে কাঙ্খিত উৎপাদন টিকিয়ে রাখার আশা করা যায় না৷বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় আবাদি জমির পরিমাণ খুবই কম, তাই এ জনগোষ্ঠীর  খাদ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে অধিক ফসল আবাদের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ৫ শতাংশ হলে সে মাটিকে সবচেয়ে ভালো বলা হয়। ন্যূনতম ২ শতাংশ থাকলে সেটিকে ধরা হয় মোটামুটি মানের।  কিন্তু মৃত্তিকা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে দেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ এখন গড়ে ২ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে, যা দেশের মোট জমির প্রায় ৭৯ শতাংশ।  অন্যদিকে  ফসফরাস ঘাটতিযুক্ত এলাকার পরিমাণ ৬৬ লাখ হেক্টর, যা মোট জমির প্রায় ৪৫ শতাংশ,পটাশিয়ামের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫২ লাখ ৭০ হাজার বা ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ জমিতে, সালফারের ঘাটতি রয়েছে ৬৫ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর বা ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ এলাকায়। এর বাইরে বোরনের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫১ লাখ ১০ হাজার হেক্টরে (মোট জমির ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ)। দিনদিন যেভাবে কৃষি জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে তা একসময় বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশের জন্য বড় বিপর্যয় হয়ে দাড়াবে।

এ পর্যায়ে মাটির স্বাস্থ্যহানীর অন্যতম কিছু কারণ আলোকপাত করছি-
জমিতে লবনাক্ত পানির প্রবেশঃ বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রতিবছর সমূদ্রের লোনা পানি প্রবেশ করে আবাদি জমি অনুর্বর করে ফেলে। এতে ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যায়। অন্যদিকে ঐ অঞ্চলের প্রকৃতি তথা জীববৈচিত্র সংকটাপন্ন হওয়ার যোগাড়। কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, লবণের কারণে ফসলের উৎপাদন ৭০ শতাংশ কমে যায়। রোপা আমনে তেমন ক্ষতি না হলেও রবিশস্য লবণ সহ্য করতে পারে না। লবণ বিস্তারের কারণে তিন ফসলী জমি এক ফসলী হয়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে শস্য বিন্যাস। লবনাক্ত মাটিতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং জিঙ্কের পরিমাণ কমে যায়।

অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগঃ অধিক ফসল ফলানোর জন্য রাসয়নিক সার ব্যবহার আবশ্যক। কিন্তু রাসয়নিক সারের একটা বিষক্রিয়া আছে। মাটিতে বেশি মাত্রায় ব্যবহার করলে তা যেমন ফসলের জন্য অনিষ্টের কারণ তেমনি মাটির প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। মাটিতে রয়েছে অনেক উপকারি অনুজীব,কীটপতঙ্গ, অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার এসব অনুজীবের বংশ বৃদ্ধি ও বেচেঁ থাকার জন্য সহায়ক নয়। অনেক কৃষক সুষমমাত্রায় সার ব্যবহার না করে অধিকহারে অনুমান ভিত্তিক সার ব্যবহার করেন ফলে মাটির ইকোসিস্টেম ধ্বংস হচ্ছে।

জৈব সার ব্যবহার না করাঃ যে মাটির জৈব পদার্থ যত বেশি সে মাটি তত সমৃদ্ধ। আমাদের দেশের কৃষকরা কৃষি জমিতে জৈব সার প্রয়োগ না করে বা ফসলের পর্যায়ক্রম না মেনে বছরের পর বছর ফসল জন্মানোর ফলে মাটির উপরিভাগের ক্ষয় আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। এর ফলে মাটি অনুর্বর বা স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়ছে। এরুপ মাটির কারনে মাটিতে উপকারি অনুজীবের পরিমান কমে যাচ্ছে অর্থাৎ মাটির প্রকৃতি বা পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।

ভারসাম্যহীন কৃষিকাজঃ প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে আবাদি জমি  হ্রাস পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মোকাবেলা করতে গিয়ে অধিক ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে এক ফসলি জমিকে দুই বা তিন ফসলি জমিতে রুপান্তর করতে হয়েছে। এর পাশাপাশি উন্নতজাতের ফসল আবাদ করতে গিয়েও জমির উপর চাপ পড়ছে।  তাছাড়া শস্য পর্যায় ঠিকমতো অবলম্বন করা হচ্ছে  না এতে মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে।

বন নিধনঃ বন উজাড় করনের কারণে মাটির উপরি স্তরের উর্বর মাটি অপসারিত হচ্ছে। আমাদের দেশে পাহাড়ি এলাকায় গাছ কেটে বন উজাড় করে ফেলা হচ্ছে। এতে মাটির জৈব পদার্থের ঘাটতি হচ্ছে।অন্যদিকে বায়ুপ্রবাহ ও প্রচন্ড রোদে বা বৃষ্টিতে ভূমি ক্ষয় প্রাপ্ত হওয়ার ফলশ্রুতিতে মাটির উর্বরতা মান কমে যাচ্ছে।

উর্বর জমির মাটি ইট ভাটায় ব্যবহারঃ প্রতি বছর জনসংখ্যার বৃদ্ধি পাচ্ছে সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নগরায়ন। নগরায়নের ফলে আবাদি জমি অনাবাদি খাতে হ্রাস পাচ্ছে। অনেক উর্বর জমিতে ইটভাটা স্থাপন করা হচ্ছে। তাছাড়া অজ্ঞতার কারনে আবাদি জমির উপরিস্তরের মাটি ইট তৈরির কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে।

এছাড়াও প্রতি বছর মৃত্তিকা ক্ষয়, নগরায়ণ, আবাদী জমিতে স্থাপনা নির্মাণ,  রাস্তাঘাট, খনিজ কর্মকাণ্ড,জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষত দীর্ঘমেয়াদি খরা প্রভৃতির কারণে মাটির স্বাস্থ্যহানী হচ্ছে।

যেসব পন্থা মেনে চললে সহজে মাটির উর্বরতা রক্ষা বা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তা উল্লেখ করছি-
জমিতে লবনাক্ত পানি প্রবেশ ঠেকাতে বাঁধ দেওয়া, অনুমান ভিত্তিক রাসয়নিক সার প্রয়োগ না করে কৃষি অফিসের পরামর্শে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা, জমিতে প্রচুর পরিমানে জৈব সার ব্যবহার করা, উর্বর জমির মাটি ইট ভাটায় ব্যবহার না করা, বৃক্ষ নিধন কে কমিয়ে আনা এবং প্রাকৃতিক বনভূমিকে সংরক্ষণ করা,সামাজিক বনায়ন বৃদ্ধি করা,যে সব ফসল মৃত্তিকার উর্বরতা ও পানিধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে যেমন ডালজাতীয় শস্য ও পাট চাষাবাদে জোর দেওয়া, নির্দিষ্ট শস্যবিন্যাস মেনে চাষাবাদ করা, অতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগে যেসব জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলোতে সবুজ সার প্রয়োগ করা যেমন ভুট্টা ক্ষেতে ভুট্টা কর্তনের আগ দিয়ে মুগ কিংবা ধইঞ্চা বপন করে সবুজ সার হিসেবে ব্যবহার করা।

মনে রাখতে হবে শুধু টেকসই কৃষি উৎপাদনই নয়, সমগ্র জীবমণ্ডলের অস্তিত্বও এখন মাটির স্বাস্থ্যের উপর নির্ভরশীল, তাই কৃষক ও কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে এবং প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লেখকঃ কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ