সমলয় চাষ–কথা অল্পই

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

ড. মো. আনোয়ার হোসেন:সমলয় বা সিনক্রোনাইজড চাষ-একটি নতুন ধারণা। বিশেষত বাংলাদেশে। গত বোরো মওসুমে অনানুষ্ঠানিক ভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ১২টি উপজেলায় “সিনক্রোনাইজড চাষাবাদ” এর আওতায় প্রতিটি এলাকায় ৬০ বিঘা জমিতে উক্ত চাষাবাদ কার্যক্রম শুরু করা হয়। চলমান বোরো মওসুমে আরো বিস্তৃত পরিসরে ৬১টি জেলায় এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বিভিন্ন ভাবে কারিগরি সহযোগীতা প্রদান করছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বাস্তবায়নে কিছু সমস্যা হলেও সমলয় চাষাবাদ একটি কার্যকরী উদ্যোগ। সমন্বিতভাবে এই ধারণাটি বাস্তবায়ন করা হলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের পথ অনেকটাই টেকসই হবে।

সমলয় চাষাবাদ সম্পর্কে এক কথায় সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। ইংরেজীতে সমলয় চাষ বা সিনক্রোনাইজড চাষ (Synchronized cultivation) বলে। সমলয় চাষ বলতে নির্দিষ্ট অঞ্চলের একাধিক কৃষক একসাথে নির্দিষ্ট ফসলের মওসুমে একই ফসল বা জাত বৃহত্তর একটি ব্লকে রোপণ করাকে বুঝায় যেখানে রোপণ এবং কর্তনের ধারাবাহিকতাকে বজায় বাখা হয়। কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বিদ্যমান অসুবিধা সমূহ দূর করার লক্ষ্যে একযোগে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় এই চাষাবাদ পদ্ধতিকে গ্রহণ করা হয়েছে। উক্ত চাষাবাদের মাধ্যমে রোপণ এবং কর্তন কাজে সমলয়তা বজায় রাখা যায়। এর ফলে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং এক জমি হতে অন্য জমিতে পরিবহণ সংক্রান্ত সমস্যা দূর করা সম্ভব। সিনক্রোনাইজড পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষক পর্যায়ে ব্যবহারকে লাভজনক করার মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমানো মূল লক্ষ্য।

কৃষিযন্ত্রপাতি পূর্ণ দক্ষতায় চালানোর জন্য বড় আকারের জমির প্রয়োজন। কিন্তু সিনক্রোনাইজড পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে ছোট আকারের পাশাপাশি অবস্থিত জমিতেও পূর্ন দক্ষতায় যন্ত্র ব্যবহার করা যায়। একই জীবন কাল বিশিষ্ট বিভিন্ন জাতের ধান চাষাবাদ অথবা বিভিন্ন জীবনকাল বিশিষ্ট ধানের জাত রোপণে জমির অবস্থানকে সিনক্রোনাইজড করার মাধ্যমে ধান কর্তনে সিনক্রোনাইজ করা সম্ভব। তবে একই এলাকায় একই জাতের চাষাবাদ করাই উত্তম। উক্ত চাষাবাদের আওতায় একই এলাকার বহু সংখ্যক কৃষককে সংযুক্ত করে মেশিন সেবার আওতায় আনা সম্ভব। বীজতলা প্রস্তুতি থেকে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত সমস্ত প্রক্রিয়া একই সাথে মেশিনের সাহায্যে করা সম্ভব।

অধিক জমিকে চাষের আওতায় নিয়ে আসা তথা চাষাবাদ বাড়ানো এবং স্বল্প শ্রম ও ব্যয়ে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের প্রণোদনামূলক কর্মসূচির আওতায় এই সমন্বিত বা সমলয় চাষ চলছে। অন্যদিকে ধান চাষাবাদে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কার্যক্রমকে দ্রুত সম্প্রসারণ এবং কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় করণও “সিনক্রোনাইজড চাষাবাদ” কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অন্তরায় সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো ফার্ম রোড। টেকসই যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা অনস্বীকার্য । পরিকল্পিত ফার্ম রোড ছাড়া বিচ্ছিন্ন ভাবে রোপণ বা কর্তনের সময় এক জমি হতে অন্য জমিতে মেশিন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। সমলয় চাষের মাধ্যমে এই সমস্যা সহজেই দূর করা সম্ভব। তাছাড়া কৃষি যন্ত্রের কর্ম দক্ষতা নির্ভর করে জমির আয়তন, আকৃতি এবং এক জমি হতে অন্য জমির দূরত্বের উপর। সমলয় চাষাবাদের আওতায় ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্র পূর্ণ দক্ষতায় ব্যবহার করা সম্ভব। সম্ভব অধিক জমি যান্ত্রিক চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসা। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কৃষককে মেশিন ব্যবহারে অভ্যস্ত করা। সরকারের প্রণোদনা বন্ধ হলেও এই অভ্যস্ততা এবং সুবিধার কথা বিবেচনা করেই তৈরী হবে আরো অনেক উদ্যোক্তা, যা রুপ নিবে স্থায়ী যান্ত্রিকীকরণে।       

চাষাবাদে যন্ত্রপাতির ব্যবহার বা আধুনিকতা নির্ভর করে সম্পদের সহজ লভ্যতা, শ্রম, মূলধন (আর্থিক এবং যান্ত্রিক), পরিবেশগত অবস্থা এবং সমাজ/দেশে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি। সকল নিয়ামকের প্রসার সমভাবে ঘটেনি বলেই সমলয় চাষের প্রসার প্রয়োজন। কারণ কৃষিকে রূপ দিতে হবে আকর্ষণীয় এবং লাভজনক পেশা হিসেবে। ধান চাষকে লাভজনক করার অন্যতম উপায় ধানের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করা। প্রচলিত পদ্ধতিতে এক হেক্টর জমিতে ধানের চারা রোপণ করতে এলাকাভেদে ব্যয় হয় প্রায় ১২-১৬ হাজার টাকা, যেখানে পূর্ণ মাত্রায় একটি রোপণ যন্ত্র ব্যবহার করলে ব্যয় হয় মাত্র ৩.০-৩.৫ হাজার টাকা। যদিও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে রোপণের ক্ষেত্রে বোরো মওসুমে ম্যাট টাইপ চারা উৎপাদন কিছুটা জটিল বলে মনে হয় কৃষকদের কাছে। তবে সমন্বিত উদ্যোগে সফল ভাবেই ম্যাট টাইপ চারা উৎপাদন করা সম্ভব। আমার পূর্ববর্তী লেখায় ম্যাট টাইপ চারা তৈরীর বিশদ কৌশল আলোচনা করেছি। ধানের চারা রোপণ ব্যয় তথা উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করার জন্য যান্ত্রিক পদ্ধতিতে রোপণ কৃষকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র। একই ভাবে ধান কর্তনের ক্ষেত্রে সময় স্বল্পতা এবং সারাদেশে প্রায় পাশাপাশি সময়ে কর্তন কাজ শুরু হওয়াতে কৃষি শ্রমিকের ব্যাপক ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। পূর্ণ ক্ষমতায় একটি কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কর্তনে যেখানে হেক্টর প্রতি ৩.৫-৪.০ হাজার টাকা খরচ হয় সেখানে হাতে কর্তন, পরিবহণ, মাড়াই এবং ঝাড়াই বাবদ এলাকাভেদে প্রায় ১৮-২০ হাজার টাকা খরচ হয়। শুধুমাত্র রোপণ এবং কর্তনে যান্ত্রিকীকরণ করা সম্ভব হলে ধান উৎপাদন খরচ হেক্টর প্রতি প্রায় ২৫-২৮ হাজার টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।



খামার যান্ত্রিকীকরণে ৩,০২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পকে সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে সরকার গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে কৃষি প্রকৌশলীদের ২৭৮ টি পদ ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে। এখন প্রয়োজন দ্রুততম সময়ে কৃষি প্রকৌশলীদের নিয়োগের ব্যবস্থা করা। প্রয়োজন সমন্বয়ের। সমন্বয় প্রয়োজন গবেষণা এবং সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, সমন্বয় প্রয়োজন কৃষি সকল কৃষি যন্ত্র প্রস্তুতকারক এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। নিশ্চিত করা প্রয়োজন মান-সম্পন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকের কাছে পৌঁছানোর। কাজটি যদিও সহজ নয়, তথাপি অসম্ভব নয়। সরবরাহের পাশাপাশি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে যন্ত্রপাতি তৈরির।  আধুনিকায়নের সাথে সাথে উন্নত জীবনের সন্ধানে মানুষ এখন শহরমুখী। তাই কৃষিক্ষেত্র হারাচ্ছে তার জনবলকে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এই সংকট আরো প্রকট হবে। সংকট সমাধানের উপায় কৃষিকে আধুনিকায়ন তথা কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। কিন্তু টেকসই যান্ত্রিকীকরণের জন্য পরিকল্পিত ভাবে বিন্যস্ত জমি, মেশিন চলাচলের জন্য রাস্তা বা যৌথ খামার ব্যবস্থা। তারজন্যই প্রয়োজন সমালয় চাষের। যার মাধ্যমে কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকার কৃষি মৌসুমে কোনো একটি কৃষি পণ্য চাষের পুরো প্রক্রিয়া একই প্রক্রিয়ার আওতায় নিয়ে আসা। ফলশ্রুতিতে জমির আল বজায় রেখে লাভজনকভাবে পূর্ণ কর্ম দক্ষতায় যন্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব। এ পদ্ধতি আরো পরিকল্পিত এবং সমন্বিত ভাবে দক্ষ জনশক্তিকে সম্পৃক্ত করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে উৎপাদনের টেকসই রূপ দেয়া সম্ভব।
লেখক:ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
এফএমপিএইচটি বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর-১৭০১।