সবজি চাষে নারী

নাহিদ বিন রফিক: নারীর হাতে কৃষির গোড়াপত্তন। অনেক আগের কথা। আদিযুগের কৃষি ছিল প্রকৃতির ওপর নির্ভর। তখনকার মানুষ জীবিকার জন্য বনজঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। পশু শিকার এবং ফলমূল সংগ্রহ করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। এগুলো করতেন পুরুষরা আর নারীরা সন্তান লালন-পালনের পাশাপাশি ফলের বীজ মাটিতে পুঁতে রাখতেন। বীজ হতে গজানো চারা বড় হয়ে যখন ফল ধারণ করত তখন তারা এ কাজে হতেন আরো উৎসাহিত। সে থেকেই কৃষিকাজে নারীর পথ চলা। অভিরাম চলছে বংশপরম্পরায়। পুরুষশাসিত সমাজে স্বীকৃতি না পেলেও কৃষিতে তাদের অবদান ঢের বেশি। বিশেষ করে সবজি চাষে।

দেশে প্রায় ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার আছে। তাদের বাড়ির আঙ্গিনায় শাকসবজি চাষ হয়। এতে সম্পৃক্ত অধিকাংশই নারী। সবজি চাষে শুধু ক্ষুদ্র-প্রান্তিকরাই নয় বিলাসী নারীদেরও অবদান আছে। ছাদকৃষি এর উদাহরণ। বর্তমানে এর সম্প্রসারণ হচ্ছে জ্যামিতিক হারে। যার উৎপাদিত ফসলের সিংহভাগ শাকসবজির দখলে থাকে। ছাদকৃষির যত্ন-আত্তি করে বৃত্তশালী নারীরা সময় কাটান। এতে তাদের মানসিক প্রশান্তি আসে। বাড়তি হিসেবে পান টাটকা এবং নিরাপদ ফসল। সবজির সাথে নারীর সম্পৃক্ততা সারাদেশে বিরাজমান। তবে কিছু এলাকার চিত্র অবাক করার মতো। দক্ষিণাঞ্চলের কথাই বলি। ‘ধান নদী খাল’ এই তিনে বরিশাল। পানিবেষ্টিত এ অঞ্চল প্রাকৃতিক কারণে সবজি আবাদে প্রতিকূল। তবুও থেমে নেই ওখানকার নারীরা। বৈরি পবিরেশে করছেন চাষাবাদ। তাইতো মাঠে মাঠে সবজিতে ছড়াছড়ি। নিচু হওয়ায় ধান ছাড়া অন্য ফসল চাষে যেখানে অন্তরায়, সে জমিতে সর্জান পদ্ধতিতে বারোমাস সবজি আবাদ হচ্ছে। এমনও স্থান আছে পানির গভীরতার কারণে স্বাভাবিকভাবে ফসল উৎপাদনে অনুপযোগী। সে সব জায়গায়ও এখন চাষের আওতায়। এমন দুটি উপজেলা হচ্ছে  ঝালকাঠি সদর এবং পিরোজপুরের নেছারাবাদ। ওখানের অধিকাংশ গ্রামের নারীরা পুরুষের সাথে কাজ করছেন সমানতালে। কিছু জায়গা আছে যেখানে বীজ বপন থেকে শুরু করে সার দেয়া, পরিচর্যা, রোগপোকা দমন, ফসল তোলা, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ এমনকি  বিপণনের কাজ নারী একাই করেন। স্বামী-স্ত্রী প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে মাঠে বেরিয়ে পড়েন। তখন চারদিকে তাকালে শুধু সবজি আর মানুষের সমারোহ। ঝালকাঠির প্রায় ৪০ টি গ্রামের দৃশ্য এমনই।

এগুলো হলো: কাপড়কাঠি, জগদীশপুর, শতদশকাঠি, শাখাগাছি, বেতরা, ভিমরুলি, গৈহার, ডুমুরিয়া, বিনয়কাঠি, বেশাইনখান, বালিগোনা, বেউখির, কাঁচাবালিয়া, গোপিনাথকাঠি, রমজানকাঠি, নাগপাড়া, শংকরধবল, খেজুরা, স্থানসিংহপুর, নবগ্রাম, পাঞ্জিপুথিপাড়া, পূর্ব বাউকাঠি, মিরাকাঠি, বহারামপুর, দিয়াকুল, পশ্চিম ভাওতিতা, দেউড়ি, রাজাপুর, হিমান্দকাঠি, দাড়িয়াপুর, গাবখান, বাউকাঠি, বিকনা, দোগলচিড়া এবং শাখাকাঠি। নেছারাবাদের গ্রামগুলোর মধ্যে আটঘর, কুড়িয়ানা, আতা, আদমকাঠি, বাস্তুকাঠি, ব্রাহ্মনকাঠি, মাদ্রা, জৌসার, জামুয়া, গণপতিকাঠি, জিন্তাকাঠি, আন্দাকুল, আদাবাড়ি, নবারুণ, ঝালকাঠি, কুঠুরাকাঠি, ধলহার, ইদিলকাঠি উল্লেখযোগ্য। এসব এলাকার চাষিরা সর্জান পদ্ধতি চাষাবাদ করেন।

সাধারণত বেডগুলো হয় ১০-১২ ফুট প্রস্থ। দুই বেডের মাঝখানে ৮-৯ ফুট বেড় বা নালা থাকে। তাদের ভাষায় পাইকা। দৈর্ঘ্যরে মাপ হয় জমি অনুযায়ী। নালার মাটি দিয়ে বেড এমনভাবে উঁচু করা হয়, যেন জোয়ার কিংবা বন্যার পানি প্লাবিত হতে না পারে। বেড বা কান্দিতে লাইন করে সবজির চারা রোপণ করা হয়। ‘বাতায়’ লাগানো হয় লতাজাতীয় সবজি। কান্দির দুইপাশের জায়গাকে স্থানীয় ভাষায় ‘বাতা’ বলে। নালার উপর থাকে মাঁচার ব্যবস্থা। তাদের ভাষায় ‘গুইররা’। নালার পচা মাটি বেডে লেপ্টে দেয়। তারা বলেন লাতা দেওয়া। এতে জৈব সারের কাজ করে। সবজির গুণগতমান বজায় থাকে।

ডুমুরিয়া এবং ভিমরুলি  গ্রামমিলে কৃষাণীর সংখ্যা  ৪ শতাধিক। কথা হয় ডুমুরিয়ার নারীচাষি নমিতা মিস্ত্রি এবং রেখা মিস্ত্রির সাথে। তখন তারা মাঠের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। রেখা জানান, তিনি প্রায় ২৬ বছর যাবত সবজি চাষ করে আসছেন। দাম্পত্য জীবনের ৮ বছর আগ থেকে এ কাজে সম্পৃক্ত। তিনি সারা বছর শাকসবজি চাষ করেন। জমির পরিমাণ  প্রায় ৪ একর। পুরোঅংশই সর্জান পদ্ধতি তৈরি। আবাদকৃত সবজির মধ্যে মূলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, শালগম, লালশাক, পালংশাক, পুঁইশাক, ধনিয়া, মরমা, শিম, করলা, কাঁকরোল, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, পেঁপে, গোলআলু, ঝিঙ্গা, কচু, কাঁচকলা অন্যতম। সে সাথে আছে বারোমাসি মরিচ, মোম্বাই মরিচ এবং আখ।  গতবছর তিনি প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেন। আর আখ বিক্রি করে পান ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। মোট উৎপাদন খরচ ছিল মাত্র ২ লাখ টাকা। তার জমিতে কাজকরা শ্রমিকদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। একই গ্রামের করুণা মন্ডল, নিপা বেপারী, নুপুর বেপারী, জয়া বিশ্বাস, কবিতা হালদার, রিতা মন্ডল, মনিকা হালদার, রাখি বেপারী,অর্চনা মিস্ত্রির মতো অসংখ্য কৃষাণীরা সবজি চাষে অভাবনীয় সফলতা ধরে রেখেছেন। তাইতো কোনো অভাব নেই। তারা এখন বেশ সচ্ছল। ফসল সংগ্রহ করে তারা নৌকাযোগে ডুমুরিয়া বাজার নিয়ে যান। সেখান থেকে ভিমরুলী বাজার, আটঘর হাট, কুড়িয়ানা বাজার, ঝালকাঠি, রাজাপুর, বাউকাঠি হাট, শশীদহাট, কাউখালী, স্বরূপকাঠি বাজার, কিত্তিপাশা বাজারে চলে যায়।

উপজেলা কৃষি অফিসার মো. রিফাত শিকদার বলেন, এ অঞ্চলে সর্জান পদ্ধতির চাষাবাদ প্রাকম হলেও দু’শত বছর পুরনো। যদিও শুরুতে পেয়ারা আবাদ হতো। কম সময় এবং বেশি লাভ হওয়ায় তারা এখন সবজি চাষের ঝুঁকে পড়েছেন। এখানের চাষি অধিকাংশই নারী। পুরুষের পাশাপাশি কাজ করার কারণে পরিবারের তাদের  গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চলমান আছে। তাই আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে তারা লাভবান হচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা তপন কান্তি বেপারী জানান, নারী চাষিদের তিনি প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে আসছেন। সময়মতো বীজ বপন, সুষমসার ব্যবহার, পরিচর্যা এবং রোগপোকা দমনের ক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বালাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তারা বিষটোপ, ফেরোমন ফাঁদসহ  জৈবিক ও যান্ত্রিক বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেন। কীটনাশকের প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট সময়ের পর ফসল সংগ্রহ করা হয়। ফলে তাদের শাকসবজি থাকে নিরাপদ। তাই বাজারে এর  চাহিদা বেশি থাকে। দামও পান কাঙ্খিত।

বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মধ্য রাকুদিয়ার সফল চাষি রিতা ব্রহ্ম বলেন, বিয়ের পরে স্বামীর সংসারে এসে দেখেন অভাবের কমতি নেই। স্বামীর ছিল পানের বরজ। তাতে যৌথ পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন চিন্তা করলেন স্বামীর পাশাপাশি তারও কিছু করার দরকার। প্রথমে বাড়ির পাশের মেহগনি গাছ কেটে সেখানে বিভিন্ন শাকসবজি চাষ শুরু করেন। তাতে প্রায় ১০ হাজার টাকা লাভ হয়। উৎসাহিত হয়ে উপজেলা কৃষি অফিসের সহযোগিতায় সবজি চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৫ সাল থেকে তিনি সারাবছর সবজি চাষ করে আসছেন। গত বছর তিনি অন্য ফসল বাদে সবজি থেকে লাভ পেয়েছেন প্রায় লাখ টাকা। সংসারে এখন  সচ্ছলতায় ভরপুর। হয়েছেন প্রশিক্ষিত। একই গ্রামের সেলিনা, হাসিনা, রাশিদা, রেহানা, রুশিয়া, অনিতা, রিফাত জাহান, রোজিনা, জাহানারা, শিল্পী, গীতা, কবিতা, কহিনুর মতো আরো অনেকে সবজি চাষ করেন। তাদের একটি কালেকশন পয়েন্ট আছে। সবার উৎপাদিত সবজি ওখানে আনা হয়। সেখান থেকে পাইকাররা কিনে নেন। ঠকতে হয় না তাদের। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রের সভাপতির পদ। ইতোমধ্যে কৃষি তথ্য সার্ভিসের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া ঘুরে এসেছেন। এছাড়া বিশ^ ব্যাংকের আহবানে আফ্রিকার দেশ সেনেগালে ভ্রমণের সৌভাগ্য অর্জন করেন। তিনি মনে করেন, সবজি চাষের মাধ্যমেই তার ভাগ্যের পরির্বতন হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক সমীক্ষা মতে, দেশের অর্থনৈতিক কর্মক্ষেত্রে নারীর অবদান বেড়েই চলছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী কৃষি, শিল্প এবং সেবাখাতে কাজ করছেন। বর্তমানে জিডিপিতে নারীর অবদান ২০ শতাংশের বেশি। কৃষিখাতে নিয়োজিত আছেন প্রায় ৯০ লাখ ১১ হাজার। গত এক যুগে এদেশে কৃষির নারীকরণ হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মতো  কৃষিতেও নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা। গত ১০ বছরে ফসল উৎপাদনে তাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে প্রায় ১০৮ শতাংশ। সবজি চাষে পুরুষের অংশগ্রহণ দিন দিন কমছে। আর তাদের শূন্যস্থান দখল করে নিচ্ছে নারীরা।

প্রান্তিক নারীদের উৎপাদিত সবজি ছড়িয়ে পড়ছে স্থানীয় হাট-বাজারে। সেখান থেকে বন্দরে, রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে, এমনকি বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে, বাংলাদেশর সবজি এবং ফল বিশে^র অর্ধশতাধিক দেশে রফতানি হয়ে থাকে। এসব দেশের মধ্যে  যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জামানি, সুইডেন, ইতালি, মালয়েশিয়া, নেপাল, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান অন্যতম।

অস্বীকারের উপায় নেই। নারীরাই কৃষির মূল চালিকাশক্তি। তাই তাদের উৎসাহিত করা দরকার। সে সাথে মর্যাদা এবং সহযোগিতার প্রয়োজন। কাজের স্বীকৃতি ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সবজিসহ অন্যান্য ফসল আবাদে তারা আরো আগ্রহী হবেন। ফলে উৎপাদনে আসবে ঈর্ষনীয় সফলতা। সংসারে আসবে স্বচ্ছলতা। নিজেদের হবে জীবনমানের উন্নয়ন। বাড়বে নারীর ক্ষমতায়ন। দেশ হবে খাদ্যে উদ্বৃত্ত। আরো সম্পদশালী।

টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস  ও পরিচালক,  কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ বেতার, বরিশাল
মোবাইল নম্বর: ০১৭১৫৪৫২০২৬; ই. মেইল:: This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.