বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক রাইসঃ অপুষ্টিজনিত ’গুপ্ত ক্ষুধা’ নিরাময়ের মহৌষধ

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

কৃষিবিদ ড. এম. মনির উদ্দিন:বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ১৯৩টি দেশ তথা বিশ্বের মধ্যে ২৫তম অর্থনীতির দেশ হিসাবে ঘুরে দাড়াবে। ২০২০ সালে করোনা মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশ বিদেশের বাজারে পোশাক রপ্তানীতে ভিয়েতনামকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এ সময়ে ভিয়েতনাম পোশাক রপ্তানী করেছে ২৭ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারের এবং একই সময়ে পোশাক রপ্তানী করে বাংলাদেশ আয় করেছে ২৯ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো বেড়ে যাওয়ায় ২০২০ সালের শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ দাড়িয়েছে ৪৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। এভাবেই দেশের প্রতিটি সেক্টরে চলছে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা।

অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার ফলে কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভুমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। ২০২০ সালের করোনাকালীন সময়ে সমগ্র বিশ্ব যখন খাদ্য উৎপাদনে পিছিয়ে। দেশে দেশে যখন দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব, সে সময়ে বাংলাদেশে শুধূমাত্র দানাজাতীয় খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৪৩ মিলিয়ন টন যার মধ্যে শুধু চালের উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৬ মিলিয়ন টন। কৃষিবান্ধব সরকারের সুদুরপ্রসারী ও সময়োপযোগী কর্মসুচী গ্রহন, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরলস প্রচেষ্টা, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম জোরদারকরন ও তদারকি এবং দেশের কৃষককুলের সক্রিয় অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে কৃষির এই অর্জনে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ন।

বিশ্বে দিন দিন পুষ্টিকর সমৃদ্ধ ফসলের চাহিদা বাড়ছে। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বে বিপুল সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে ডুবে যাবে এবং তুলনামুলকভাবে সস্তা খাবারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ২০২০ সালের গেøাবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস রিপোর্ট অনুযায়ী অনুমান করা যায় যে, কোভিড-১৯ সারা বিশ্বে আরো ১০০ মিলিয়ন মানুষকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। করোনা পরিস্থিতির কারনে বাংলাদেশেও নুতন করে ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে নেমে গেছে। ফলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাড়িয়েছে ৪২ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ১৬ কোটি ৫০ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে ৩ কোটি ৩০ লাখ দরিদ্র। এর মধ্যে আবার ১ কোটি ৭০ লাখ অতি দরিদ্র। তবে বেসরকারী গবেষণা সংস্থাগুলোর মতে, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। যেহেতু মানুষের হাতে খাবারের জন্য যথেষ্ট অর্থ নাই, তাই তারা পেট ভরাতে সস্তা দামের দানাজাতীয় প্রধান খাবারের উপর বেশী নির্ভরশীল হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই পরিস্থিতি একটি পরিষ্কার উদাহরন। কারন দেশের করোনা পরিস্থিতিতে অল্প আয়ের মানুষ চাল ও গমের উপর এখন বেশী নির্ভরশীল হয়েছে যার কারনে ইতিমধ্যে দেশের চালের উপর চাপ বেড়েছে।

বিশ্বে তিনজনের মধ্যে একজন মানুষ ’লুকানো ক্ষুধা’ নামক মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টজনিত ঘাটতিতে ভোগেন। দ্রুত খাবার খাওয়ার ফলে ক্ষুধা মেটানো যায়, তবে ’গোপন ক্ষুধা’ এর গভীর সমস্যা রয়েছে যা পুষ্টিগতভাবে সমৃদ্ধ খাবারের মাধ্যমে পরিপুর্ন হয়। বিশ্বব্যাপী সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য সুষম খাবার গ্রহন করা হলো একটি সুদূর স্বপ্ন। বিশ্ব জুড়ে চাল, গম ও ভুট্টা প্রধান কার্বহাইড্রেটযুক্ত খাবার খাওয়া হয় এবং ক্ষুধার সমস্যা সমাধানে অবদান রাখে, তবে ’গোপন ক্ষুধা’ এখনও বিশ্বে অব্যাহত রয়েছে। এই ’গোপন ক্ষুধার’ কারন হলো দেহ প্রয়োজনীয় মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট থেকে বঞ্চিত হয়। দেহে প্রয়োজনীয় মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের অভাব একটি নীরব মহামারী অবস্থা যা আস্তে আস্তে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল করে দেয়, শারীরিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে এমনকি মৃত্যুর কারনও হতে পারে। মানবদেহে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টস বিশেষ করে আয়োডিন, আয়রন, ভিটামিন-এ এবং জিঙ্কের ঘাটতি ব্যাপক আকার ধারন করে এবং এর ফলে গুরুতর পরিণতি ঘটে। ’লুকানো ক্ষুধা’ এবং অপুষ্টিজনিত কারনে বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন ২৪ হাজারের বেশী মানুষ মারা যায়। মানবদেহে তাই এই সমস্ত মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টসগুলোর ঘাটতি মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন জৈবিক এবং রাসায়নিকভাবে পুষ্টি উপাদানগুলো যুক্ত করে প্রয়োজনীয় বা প্রধান খাদ্যেকে শক্তিশালী করার চেষ্টা চলছে বিশ্বব্যাপী।

বায়োফর্টিফিকেশন, অর্থাৎ ফসলের ব্রিডিং বা প্রজননের মাধ্যমে প্রধান খাদ্যের মধ্যে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টস এর পরিমান বৃদ্ধি করা যাতে কৃষিভিত্তিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দরিদ্র শ্রেনীর মানুষের স্বাস্থ্যের অন্যতম বাধা অপুষ্টিজনিত সমস্যাকে দুরীভুত করা। গত দুই দশকে মানব শরীরে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি কমানোর জন্য গতানুগতিক খাদ্য পরিপুরক গ্রহন, খাদ্যে ফর্টিফিকেশন এবং খাদ্য তালিকার বহুমুখীকরনের চেয়ে প্রধান খাদ্য মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধ করার জন্য বায়োফর্টিফিকেশন এর উপর কাজ করা হয়েছে। বিশ্বে খাদ্যে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এর ঘাটতির প্রেক্ষাপটে জিনগত যেমন উদ্ভিদ প্রজনন ও কৃষিতাত্বিক কলাকৌশলের মাধ্যমে বায়োফর্টিফাইড প্রধান খাদ্য গ্রহনের পরিমান বাড়িয়ে দরিদ্র মানুষের মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি পুরনে সহায়ক হতে পারে।

আয়রন ও জিঙ্কের ঘাটতি বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানব স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। জিঙ্ক মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ন একটি মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট। বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানব শরীরে জিঙ্কের ঘাটতি প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষের জন্য বিরাট একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। এর অধিকাংশ হলো গর্ভবতী মহিলা ও পাঁচ বছরের নীচের শিশুরা। সেই সমস্ত অঞ্চলে মানব শরীরে জিঙ্কের সমস্যা বেশী যেখানে মাটিতে জিঙ্কের পরিমান কম থাকে। গবেষনায় আরো জানা যায় যে, মানব শরীরে জিঙ্কের ঘাটতির অন্যতম কারন হলো সাধারনত বেশী পরিমানে দানাজাতীয় খাবার গ্রহন ও কম পরিমানে প্রানিজ খাদ্য গ্রহন।

দুর্ভাগ্যক্রমে, মানব স্বাস্থ্যের জন্য লুকায়িত ক্ষুধা যেমন যেমন মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টজনিত অপুষ্টি একটি বিরাট সমস্যা যার কারনে শিশুদের মধ্যে বৃদ্ধির বিকাশে বাধা তৈরী করে। তবে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টের ঘাটতির মধ্যে জিঙ্কের ঘাটতি সমস্যা ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারনে আরো প্রকট হয়ে দেখা দিবে। কৃষিক্ষেত্রের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জ হলো পরিবর্তিত বৈশ্বিক জলবায়ুতে খাদ্য, সম্পদ এবং পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আরও পুষ্টিকর কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশ অর্থাৎ ৯০ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে জিঙ্কের অভাব রয়েছে। প্রাক-স্কুল বয়সী শিশুদের ৪৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন এবং ৫৭ শতাংশ গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী অর্থ্যাৎ প্রায় ২০ মিলিয়ন মহিলাদের মধ্যে জিঙ্কের ঘাটতি রয়েছে যার কারনে এরা খর্বাকৃতির হয়ে যাচ্ছে এবং প্রায়ই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। দেশের ৫ বছরের কম বয়সী ৪১ শতাংশ অর্থ্যাৎ ৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন শিশু জিঙ্কের ঘাটতিজনিত কারনে খর্বাকৃতির হচ্ছে।

দেশের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলি যখন সামর্থ্য থাকে তখন শাকসব্জি ও মাংস দিয়ে ভাত খায়। শুধু বেশী পরিমানে ভাত খেলে সঠিক পরিমানে পুষ্টির জন্য জিঙ্ক পাওয়া যায় না। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের ভাতভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠেছে তাই ভাতের মাধ্যমে যাতে অধিক পুষ্টির যোগান পায় বিশেষ করে জিঙ্কের ঘাটতি পুরনের জন্য বিশ্বের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি) ২০১৩ সাল থেকে অদ্যাবধি মোট ৫টি বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। ভাত বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য এবং নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতিদিন ভাতের জন্য চাল দরকার হয় ৩৯০ গ্রাম থেকে সর্বাধিক ৪৫০ গ্রাম। এক্ষেত্রে ব্রি’র উদ্ভাবিত বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ জাতগুলো মানুষের প্রতিদিনের জিঙ্ক চাহিদার ৯০ শতাংশ পুরন করতে সক্ষম।

ব্রিধান-৬২ঃ আমন মৌসুমের সবচেয়ে আগাম বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত। চাল সরু আকৃতির এবং এতে উচ্চমাত্রার প্রোটিন ও মধ্যম মাত্রার জিঙ্ক রয়েছে। এর জীবনকাল ১০০ দিন যা ব্রিধান-৩৩ এর চেয়েও ১০-১২ দিন আগে আসে। আশ্বিনের শেষ সপ্তাহে ধান কেটে আলু বা অন্যান্য রবিশস্য করা যায়। ১ কেজি চালে জিঙ্কের পরিমান ১৯.৮ মিলিগ্রাম।

ব্রিধান-৭২ঃ জিঙ্ক সমৃদ্ধ আমনের একটি আগাম জাত। জীবনকাল ১২৫ দিন। আশ্বিনের শেষে ধান কাটার পর সহজেই রবিশস্য চাষ করা যায়। চাল লম্বা ও মোটা এবং ১ কেজি চালে জিঙ্কের পরিমান ২২.৮ মিলিগ্রাম।

ব্রিধান-৬৪ঃ বোরো মৌসুমের বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত যার জীবনকাল ১৫২ দিন। ১ কেজি চালে জিঙ্কের পরিমান ২৪ মিলিগ্রাম।

ব্রিধান-৭৪ ও ব্রিধান-৮৪ঃ বোরো মৌসুমের বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত যাদের জীবনকাল ১৪৫ দিন। ১ কেজি চালে জিঙ্কের পরিমান ২৪.২ মিলিগ্রাম।

আমন মৌসুমের বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাতগুলো হেক্টরে ৪.৫ টন থেকে ৬.৫ টন ফলন দিতে সক্ষম। বোরো মৌসুমের জিঙ্ক জাতের ধানের ফলন হেক্টরে ৬.৫ টন থেকে ৮.৫ টন। যদিও বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক রাইসের মাধ্যমে দেশের মানুষের জিঙ্কের ঘাটতি পুরনে একটি প্রতিশ্রুতবদ্ধ সমাধান। কিন্তু দেশে এখোনো ব্রি উদ্ভাবিত বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাতগুলোর চাষ মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারন করা সম্ভব হয়নি। হারভেস্ট প্লাস এর তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের প্রযুক্তি গ্রহন করা কৃষকের সংখ্যা মাত্র এক লাখ। তাদের মতে, চাষ করা এক লাখ কৃষকের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ কৃষক দ্ধিতীয়বার জিঙ্ক রাইস চাষ করার জন্য বীজ সংরক্ষন করেছে। বাকী ৯০ শতাংশ কৃষক জিঙ্ক সমৃদ্ধ এই ধানের জাতগুলো কৃষিতাত্বিক পারফরম্যান্স ভাল না হওয়ায় অসন্তষ্ট।

দেশে শিশু ও মহিলাসহ বিরাট অংশের মানুষের মধ্যে জিঙ্কের ঘাটতিজনিত অপুষ্টি থাকা সত্ত্বেও ব্রি কর্তৃক উদ্ভাবিত এমন গুরুত্বপুর্ন প্রযুক্তিগুলি মাঠ পর্যায়ে কেন সফলভাবে পৌছানো যাচ্ছে না বা কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে না তা নিয়ে বিশদভাবে জানার চেষ্টা করে এর নেপথ্যে যে সকল সমস্যা বা বাঁধা কাজ করছে তা নিম্নরুপঃ

১) বর্তমানে বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ যে সকল ধানের জাতগুলো রয়েছে তা ভোক্তাদের পছন্দের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ন নয়। যেমন জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত বিশেষ করে ব্রিধান-৭৪ এর চাল মোটা হওয়ায় গ্রাহকরা পছন্দ করেন না। কারন তারা চিকন চাল খেতে পছন্দ করে। এর পিছনে মিলারদের একটি বড় ভুমিকা রয়েছে। দেশে কাটারীভোগ বা নাজিরশাইল জাতের ধান আমন মৌসুমে দেশের কোথাও কোথাও সামান্য চাষ হলেও বোরো ধান উঠার সাথে সাথে বাজারে এই সব বাহারী নামের চিকন চাল পাওয়া যায় এবং ভোক্তারা তা প্রতি কেজি ৬০-৭০ টাকায় ক্রয় করে। অথচ দেশে সর্বাদিক চাষকৃত ব্রিধান-২৮ ও বিধান-২৯কে কেটে ছেটে এই সমস্ত বাহারী নামে বাজারে বিশেষ ব্র্যান্ড হিসাবে বাজারজাত করা হচ্ছে। এ সমস্ত কারনে মিলাররা চিকন চাল তৈরী ও বিক্রি করে যেমন বেশী লাভবান হচ্ছে। অন্যদিকে ভোক্তাগনও তথাকথিত চিকন চাল পাওয়ায় মোটা চাল খাওয়ায় আগ্রহী হচ্ছে না।

২) দেশের অধিকাংশ মানুষ বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল সর্ম্পকে বা এর গুনগতমান সর্ম্পকে মোটেই সচেতন নয় এবং তারা এই জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল বা ধান সর্ম্পকে জানেন না। আজকাল ডাক্তারের কাছে যে কোন চিকিৎসার জন্য গেলে বিশেষ করে শিশু ও মহিলাদের ক্ষেত্রে জিঙ্ক সমৃদ্ধ সাপ্লিমেন্টারী ঔষধ খাওয়ার পরামর্শ বা প্রেসক্রিপসন করে দিচ্ছে। অর্থাৎ আমরা রাসয়নিক ফর্মুলায় তৈরী করা জিঙ্ক খাচ্ছি কিন্তু ভাতের মাধ্যমে যে এই উপাদানটি আমরা প্রাকৃতিকভাবে পেতে পারি তা জানি না। দেশের মিলারগন ভোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী চিকন চাল তৈরী করে বাজারে সরবরাহ করে থাকে। এই চ্যালেঞ্জের কারনে গ্রাহকরা জিংক চালের জন্য উৎসাহ দেখান না এবং কৃষকরাও এই ধান চাষ করতে আগ্রহী হন না।

৩) হারভেস্ট প্লাস ও জিঙ্ক ধান করা কৃষকের মতে, মিলারগন জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধান আলাদা না করে অন্যান্য সকল ধানের জাতের সাথে মিশ্রিত করে ফেলছে যার কারনে বাজারে জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল ব্র্যান্ড হিসাবে আসছে না। এর ফলে বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাতগুলির বানিজ্যিক চাষের সম্ভাবনা থাকা সত্বেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না।

জিঙ্ক মানুষের ইমিউন ফাংশন বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন যা ভাইরাস এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক স্বাস্থ্য হুমকির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রথম সারির হাতিয়ার। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক ১১-১২ মিলিগ্রাম জিঙ্কের দরকার হয় যার ৪০-৫০ শতাংশ বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল থেকে পুরন করা যায়। কারন জিঙ্ক সমৃদ্ধ জাতগুলোতে সাধারন জাতের তুলনায় ৫০ শতাংশ জিঙ্ক বেশী থাকে। দেশের শিশু ও মহিলাসহ বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে জিঙ্কের ঘাটতিজনিত অপুষ্টি দুর করতে জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাতগুলোর মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারনের কোন বিকল্প নেই। মাঠ পর্যায়ে সফলভাবে এই জাতগুলো সম্পসারনের জন্য যা করনীয়ঃ

১) প্রথমেই যে কাজটি করা জরুরী সেটি হচ্ছে, জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল সর্ম্পকে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে মানব শরীরে জিঙ্কের গুরুত্ব, জিঙ্ক সমৃদ্ধ চালের গুনাবলী সর্ম্পকে মানুষকে সচেতন করতে হবে। কৃষকদের মাঝে ভর্তুকি মুল্যে জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের বীজ সরবরাহ করে এই ধান চাষে কৃষকদেরকে উৎসাহিত করার ব্যবস্থা নিলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে।

২) কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের মাধ্যমে জিঙ্ক ধানের প্রদর্শনী স্থাপন করে মাঠ দিবসের আয়োজন করার মধ্য দিয়ে প্রচার করা এবং কৃষকদেরকে এই ধান চাষে উৎসাহিত করা।

৩) সরকারের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসুচীতে সাধারন চালের পরিবর্তে বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এর ফলে দেশে জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের চাষ অনেক সহজেই বেড়ে যাবে। সরকারী এই সমস্ত কর্মসুচীর একটি বড় সুবিধা হলো যে, এর মাধ্যমে নিম্ন আয়ের পরিবারকে চাল সহায়তা দেয়া হয় যাদের মধ্যে জিঙ্কের ঘাটতি অত্যন্ত বেশী। যদি এই সমস্ত পরিবার জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল পায় তবে তাদের দেহের জিঙ্ক ঘাটতি পুরনে সহায়ক হবে।

৪) মিলারদের মাধ্যমে জিঙ্ক জাতের চালের বিশেষ ব্র্যান্ডিং করে বাজারে ছাড়ার ব্যবস্থা করা যার মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে এই চালের উপকারীতা সর্ম্পকে সচেতন করতে সহায়ক হবে। এই বিশেষ প্যাকেটজাত জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল শহরের দোকানগুলোতে পাওয়া গেলে উচ্চ আয়ের গ্রাহকগন প্রয়োজনে কিছুটা বেশী মুল্য দিয়ে হলেও কিনতে আগ্রহী হবে। জিঙ্ক চাল বাজারে ব্র্যান্ড হিসাবে চালু করতে পারলে এর চাহিদা বেড়ে যাবে যার ফলে মিলাররাও আগ্রহী হবে এই জিঙ্ক চালের আলাদা ব্র্যান্ড ও প্যাকেট করতে। এভাবেই চাহিদা বাড়তে থাকলে কৃষকেরাও বানিজ্যিকভাবে এই সমস্ত জিঙ্ক ধানের চাষে আগ্রহী হয়ে উঠবে যা সর্বোপরি দেশের মানুষের জিঙ্কের ঘাটতিজনিত অপুষ্টি দুরীভুত হবে।

বাংলাদেশ অতি সম্প্রতি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারনেই আমাদের এই বিশাল অর্জন। আগামীদিনে আমাদের দেশের অর্থনীতি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে। দেশে দক্ষ জনবল তৈরী হবে, দেশের কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতে অগ্রগতির ধারায় আরো গতি আসবে। এভাবেই বাংলাদেশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন-২০৪১ অর্থাৎ উন্নত দেশে পরিনত হবে। আর এই অগ্রগতির জন্য সুস্থ শক্তিশালী জাতি গঠনের জন্য নিশ্চিত করার প্রয়োজন হবে দেশের মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা। এক্ষেত্রে বায়োফর্টিফাইড জিঙ্ক সমৃদ্ধ চাল সেই পুষ্টি নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সুরক্ষার মাধ্যমে সুস্থ সবল জাতি গঠনে গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা রাখবে।                                                 
 
লেখক:কলামিষ্ট ও উন্নয়ন কর্মী