সকলের কৃষিবিদ দিবস

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

ড. মো. আনোয়ার হোসেন:আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি । কৃষিবিদ দিবস। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। কৃষিকে ঘিরেই এদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। সকল ক্ষেত্রেই কৃষির প্রভাব দৃশ্যমান । স্বাধীনতা পরবর্তী প্রত্যেকটি সবকার প্রধানের দায়িত্ব ছিল কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। দেশে এখন ভাতের অভাব নেই। এটি আমাদের জাতীয় জীবনের একটি অসামান্য অর্জন। এ অর্জনের নেপথ্যে সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার সঙ্গে বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি সহায়তা, বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণ কর্মীদের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

কৃষির গুরুত্ব অনুধাবন করেই কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদায় উন্নীত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি যথাযথ মূল্যায়নের ঐতিহাসিক ঘোষণাটি দিয়েছিলেন। ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা কৃষি শিক্ষাকে পেশা হিসাবে গ্রহণের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়ন তথা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ দেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী ভূমিকা পালনে আগ্রহী হয়।

কৃষির প্রাণ কৃষক, আর কৃষকের কল্যাণে নিবেদিত এদেশের কৃষিবিদ। কৃষিবিদরা কৃষির উৎকর্ষতার জন্য গবেষণা করেন, গবেষণা থেকে উদ্ভাবিত হয় নতুন প্রযুক্তি, আর সেই প্রযুক্তি মাঠে সম্প্রসারণও করেন কৃষিবিদরা। বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে আমরা যতই উন্নতি করি না কেন, খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য আমাদের বারবার ফিরে যেতে হয় কৃষি ও কৃষকের কাছে। আর এতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এ দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা ও কৃষিবিদরা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে দেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১২ লাখ। আর চালের উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোটি টন। সে দেশে গত পাঁচ দশকে জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি। প্রতিনিয়তই আমাদের দেশের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বিশেষ করে শিল্পকারখানা স্থাপন, নগরায়ন, আবাসন, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও নদী ভাঙনের ফলে প্রতি বছর ০.৪৩% হারে কৃষিজমি কমছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার কারণেও প্রতিদিন ফসলি জমি কমছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মানুষের খাদ্যের চাহিদা। এই বিপুল পরিমাণ জনগণকে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে কৃষিবিদরা দিন-রাত পরিশ্রম করে নতুন নতুন জাত এবং প্রযুক্তি আবিষ্কার করছে।

উদাহরণস্বরুপ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) কথা উল্লেখ করা যায়। ব্রি উদ্ভাবিত ১০৫টি উচ্চ ফলনশীল বা উফশী ধানের জাত (০৫টি হাইব্রিডসহ) ও আনুষঙ্গিক লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার, সরকারের কৃষি বান্ধব নীতি এবং সর্বোপরি আমাদের কৃষকভাইদের অক্লান্ত মেহনতের ফলে জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে চালের উৎপাদন বর্তমান সাড়ে তিন কোটি টন ছাড়িয়ে গেছে। আর এই নতুন নতুন জাত কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে কৃষিবিদরা। উন্নতজাতের বীজ, সুষম সার ব্যবহার, সেচ সুবিধার কারণে আমাদের কৃষি উৎপাদন উল্লেখ্যযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে কৃষিতে এখন বহুমুখীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ ঘটছে। লবণাক্ত পানি সহিষ্ণু , খরা সহিষ্ণু এবং জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের ফলে দেশের সকল জেলায় ধান চাষ আরো সম্প্রসারিত হয়েছে। তবুও বসে নেই কৃষিবিদরা।

আবাদি জমির পরিমাণ যেহেতু বাড়ানোর সুযোগ নেই, তাই কাজ করছে উলম্ব ফলন বৃদ্ধি। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মাথায় রেখেই কৃষিবিদরা গ্রহণ করছে নতুন নতুন পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ। তাছাড়া, বর্তমানে কৃষিকে কেন্দ্র করে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বাস্তবায়িত হচ্ছে টেকসই যান্ত্রিকীকরণের নানাবিদ প্রকল্প। কৃষিতে আধুনিকতার ছোঁয়া এখন সর্বত্র। বাংলাদেশ তার শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও উন্নয়নের ক্ষেত্রে আজ বিশ্বের দরবারে একটি মডেল। খাদ্য ঘাটতির দেশ আজ খাদ্য রপ্তানির দেশে পরিণত হয়েছে। তাই কৃষিকে আর কৃষকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কোনো অবকাশ নেই। আজ কৃষি একটা শিল্প। আর এ শিল্পে অংশগ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে দেশের প্রতিটি মানুষের। ২০১১ সাল থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে যে দিনটিকে ‘কৃষিবিদ দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে তা আজ শুধু কৃষিবিদদের দিবস নয়, এ দিবস আজ সকলের। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং কৃষিবিদদের নিষ্ঠা আর ত্যাগেই গড়ে উঠবে আগামীর বাংলাদেশ, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

লেখক:ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এফএমপিএইচটি বিভাগ, ব্রি