"বঙ্গবন্ধু ঘোষিত কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান ও কৃষিতে বাংলাদেশ"

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

কামরুল হাসান কামু:যে ব্রত নিয়ে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয়েছিলো,দীর্ঘসময়ে তার কোন প্রতিফলন ঘটেনি বরং পূর্বপাকিস্তানের মানুষদের ওপর পশ্চিমাদের শোষন-পেষণের চিত্রপট ছিলো ভয়ানক।পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর নীলথাবায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে পূর্ববাংলার কৃষকশ্রেণী। সোনারমতো খাঁটি,উর্বরা ভূমি ছিলো অথচ এদেশের মানুষ দুইবেলা পেটভরে খেতে পারতোনা। প্রকৃতি নির্ভর কৃষিব্যবস্থা বিরাজমান ছিল। আদতে খরা,বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনার অভাবে অধিকাংশ জমি ছিলো এক ফসলি উপরন্তু স্থানীয় জোতদার ও আধা-সামন্ত গোষ্ঠীদের আচরণে এদেশের বর্গাচাষীদের অবস্থা নাজুক ছিলো।এসমস্ত চিত্রের মধ্য থেকে চূড়ান্ত উত্তরণে মুক্তির দিশারী ছিলেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তেইশ বছরের দীর্ঘসংগ্রামের পর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেলাম নতুন ঠিকানা, আমাদের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে লাখ লাখ কৃষক জনতা শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তির উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধে।দেশ স্বাধীন হবার পর সোনার বাংলা বিনির্মাণে দেশের কৃষকশ্রেণীর মুক্তির লক্ষ্যে কাজ শুরু করলেন স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।তিনি প্রথমে কৃষকদের অধিকারের কথা সাংবিধানিক রূপ দিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,"রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব হলো মেহনতি মানুষ-কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি এবং জনগণের মধ্যে পিছিয়ে পড়া অন্য গোষ্ঠীগুলোকে সব ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি দেয়া। সংবিধানের ১৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,"শহর ও গ্রামের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ধাপে ধাপে দূর করার উদ্দেশ্যে -

-কৃষি বিপ্লবের বিকাশ ঘটাতে হবে,
-শিক্ষা,যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রাম অঞ্চলের আমূল পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
-কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়া সংবিধানের ১৮ক নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,"রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্যে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ,জীববৈচিত্র,জলাভূমি,বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে।

স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না।খাদ্য ঘাটতি সংকুলানে বঙ্গবন্ধুসরকার স্বাধীনতার পর ২ বছর খাদ্যে ভর্তুকি প্রদান করেছে। ১ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি সেচসুবিধায় বেশি বিনিয়োগ ধরা হয়েছিলো। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে সেচে বরাদ্দ ছিলো ৩৬৬ মিলিয়ন টাকা,শস্য উৎপাদনে বরাদ্দ ছিলো ৩২১.৯০ মিলিয়ন টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষিতে বরাদ্দ ছিলো মোট এডিপি'র ১৩.১৪% যা সময়ের প্রেক্ষাপটে আশাব্যঞ্জক ছিলো।

দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার নিমিত্তে দুনিয়াজোড়া সবুজ বিপ্লবের সাথে বঙ্গবন্ধু সম্পৃক্ত করলেন দেশের কৃষি ব্যবস্থাপনা।এর জন্যে দরকার পড়ে উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল,রাসায়নিক সার,কীটনাশক ও সেচ ব্যবস্থার।এইসব উপাদানকে সহজলভ্য করার জন্যে তিনি সরকারি আদলে গড়ে তুললেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেমন:

৭৩' এর ১০নং অ্যাক্টের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। ধান ছাড়া অন্যান্য ফসলের গবেষণার উদ্যোগ নেয়া হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে।পুনর্গঠন করা হয় হর্টিকালচার বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, সীড সার্টিফিকেশন এজেন্সি, রাবার উন্নয়ন কার্যক্রম, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ গবেষণা সমন্বয়ের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল।বাংলার সোনালী আঁশের সম্ভাবনার দ্বার বিস্তৃত করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় পাট মন্ত্রণালয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,ভূস্বামীদের হাত থেকে বাংলার ভূমিহীন কৃষকদের রক্ষার্থে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে পরিবারপ্রতি জমির মালিকানা ৩৭৫ বিঘা থেকে কমিয়ে ১০০ বিঘায় নামিয়ে আনেন এবং ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মুওকুফ করেন। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-১৩৫ এ বঙ্গবন্ধুর কৃষি সংস্কার ও কৃষক দরদি মনোভাবের আরো কিছু পরিচয় পাওয়া যায়।এই আদেশে বলা হয়েছে,নদী কিংবা সাগরগর্ভে জেগে ওঠা চরের জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে দরিদ্রতর কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা। মহাজন ও ভূমিদস্যুদের হাত থেকে গরিব কৃষকদের রক্ষাই উদ্দেশ্য ছিল তার। সে কারণে হাট বাজারে ইজারা প্রথার বিলোপ করেন। এক্ষেত্রে তিনি কৃষিজপণ্যের ক্ষুদে বিক্রেতাদের শুল্ক থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন।

তাঁর আমলে দেশে প্রবর্তন করা হয় কৃষি ঋণ ব্যবস্থার এবং ৭৩’এর ৭ নং অ্যাক্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয় কৃষি ব্যাংক; গঠন করা হয় কৃষিতে জাতীয় পুরস্কার তহবিল।১৯৬৮-৬৯ সালে কৃষিকাজের জন্যে সারাদেশে ১১ হাজার শক্তিচালিত পাম্প ছিলো।বঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনায় ৭৪-৭৫ সালে পাম্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজারে।ফলে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ এক তৃতীয়াংশ বেড়ে ৩৬ লাখ একরে উন্নীত হয়।

বিজ্ঞান ভিত্তিক চাষের গুরুত্ব তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তাইতো কৃষিবিদদের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আলোকিত দিন কারণ এই দিনে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে। তৎকালীন বাকসুর সাধারন সম্পাদক,বর্তমান সরকারের মাননীয় কৃষিমন্ত্রী,বরেণ্য কৃষিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক,কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর সম্মান দেবার বিষয় বঙ্গবন্ধুর কাছে উত্থাপন করার প্রেক্ষিতে,বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর সম্মান দিয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক কৃষি শিক্ষায় উৎসাহিত করেছিলেন। তাঁর প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, 'কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। সবুজ বিপ্লবের কথা আমরা বলছি। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের যে অবস্থা, সত্য কথা বলতে কী বাংলার মাটি, এ উর্বর জমি বারবার দেশ-বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ও শোষকদের টেনে এনেছে এই বাংলার মাটিতে। এই উর্বর এত সোনার দেশ যদি বাংলাদেশ না হতো, তবে এতকাল আমাদের থাকতে হতো না। যেখানে মধু থাকে, সেখানে মক্ষিকা উড়ে আসে। সোনার বাংলা নাম আজকের সোনার বাংলা নয়। বহু দিনের সোনার বাংলা। বাংলার মাটির মতো মাটি দুনিয়ায় দেখা যায় না। বাংলার মানুষের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলার সম্পদের মতো সম্পদ দুনিয়ায় পাওয়া যায় না।

'তিনি কৃষির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলেন, 'যেভাবে মানুষ বাড়ছে যদি সেভাবে আমাদের বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে, তবে ২০ বছরের মধ্যে বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে। 'সে কারণেই আমাদের কৃষির দিকে নজর দিতে হবে এবং কৃষিবিদদের উদ্দেশে বলেন, 'আপনাদের কোট-প্যান্ট খুলে একটু গ্রামে নামতে হবে। কেমন করে হালে চাষ করতে হয়, এ জমিতে কত ফসল হয়, এ জমিতে কেমন করে লাঙল চষে, কেমন করে বীজ ফলন করতে হয়। আগাছা কখন পরিষ্কার করতে হবে। ধানের কোন সময় নিড়ানি দিতে হয়। কোন সময় আগাছা ফেলতে হয়। পরে ফেললে আমার ধান নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো বই পড়লে হবে না।গ্রামে যেয়ে আমার চাষি ভাইদের সঙ্গে প্রাকটিক্যাল কাজ করে শিখতে হবে। তাহলে আপনারা অনেক শিখতে পারবেন। অনেক আগে কৃষি বিপ্লবের কথা বলছি। ৫০০ কোটি টাকার ডেভেলপমেন্ট বাজেট করেছিলাম এবং ১০১ কোটি টাকা কৃষি উন্নয়নের জন্য দিয়েছি। ভিক্ষা করে টাকা আমি জোগাড় করেছি।'

আদতে বাংলার দুঃখী মানুষের কথা ভেবে,তাদের মুখে খাদ্যের যোগান নিশ্চিতকরণে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদীর্ঘপরিকল্পনায় বাংলাদেশে আধুনিক কৃষির ভিত্তি প্রোথিত ছিল। প্রতিনিয়ত কৃষিজমির পরিমাণ কমছে,ক্রমশ বাড়ছে জনসংখ্যা। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান নিশ্চিতকরণে কাজ করে যাচ্ছে কৃষক,কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানীগণ। রাতদিন গবেষণার মাধ্যমে কৃষিবিজ্ঞানীগণ আবহাওয়া উপযোগী উচ্চফলনশীল ফসলের জাত উপহার দিচ্ছেন, মাঠপর্যায়ে কৃষিবিদদের মাধ্যমে যা কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, কৃষিবিদদের শ্রমঘাম,ত্যাগে খাদ্যঘাটতির বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষি,মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের অভূতপূর্ব উন্নয়নের স্রোতধারা আন্তর্জাতিকভাবে স্থান করে নিয়েছে। ধান উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৩য়, সবজি উৎপাদনে ৩য়, আলু উৎপাদনে ৭ম, আম উৎপাদনে ৭ম, পাট রপ্তানিতে ১ম, কাঁঠাল উৎপাদনে ২য়, স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে ৩য়, ছাগল উৎপাদনে ৪র্থ, ফল উৎপাদনে ১০ম, বিশ্বে মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। তৃতীয় বিশ্বের একটি ছোট্ট দেশের এইসব সাফল্য দেখে এ পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়।

বাংলাদেশের মানুষের কাছে কৃষিবিদদের গুরুত্বের রূপরেখা আরো প্রস্ফুটিত হয়েছে সাম্প্রতিক মহামারীর সময়ে। বিশ্বমোড়লেরা যখন খাদ্য ঘাটতির চিন্তার ঘেরাটোপে আচ্ছন্ন ছিলো তখনো বাংলাদেশের কৃষি আপন মহিমায় অবরুদ্ধ অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছিলো। বিশ্বের অনেক দেশের কাছে বাংলাদেশের কৃষি আজ রোলমডেলে পরিণত হয়েছে। কৃষির এই আধুনিকায়ন এসেছে কৃষিবিদদের মাধ্যমে। কৃষি আজ শিল্পে পরিণত হচ্ছে, বিকাশমান বাণিজ্যিক কৃষির মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শতশত তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের পথ দেখাচ্ছে কৃষিবিদরা। বঙ্গবন্ধুর দেয়া কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান মর্যাদা আজ সার্থক হয়েছে। ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদ দিবসের মাধ্যমে সারাদেশের কৃষিবিদ সমাজ প্রাণের স্পন্দনে আনন্দে উদ্বেলিত হয়। সত্যিকার অর্থে কৃষিবিদরা খুব কাছ থেকে বুঝতে পারে মাটির টান, বুঝতে পারে কৃষকের অনুভব। মাটির কাব্যের প্রতিটি পরতে পরতে কৃষকের প্রাণের সাথে প্রাণ মিলিয়ে আগামীর বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কৃষিবিদরা।
================
লেখক:কৃষি সম্প্রসারণ কমকর্তা,ফুলপুর,ময়মনসিংহ।
ইমেইলঃ This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.