পোল্ট্রি ও প্রানিজ আমিষ....

ডাঃ শাহজাহান সিরাজ,DVM:পোল্ট্রি  শব্দটি বহুল প্রচলিত একটি শব্দ, যার মাধ্যমে সাধারণত আমরা মুরগিকে বুঝি। অথচ পোল্ট্রি বিজ্ঞানে পোল্ট্রি বলতে শুধু মুরগিকে বুঝানো হয় না, বরং যে সমস্ত পাখিকে মানুষের অধীনে বাণিজ্যিকভাবে লালন-পালন ও প্রজনন করানো যায় তাদের সবাইকে একত্রে পোল্ট্রি বলা হয়। ১১ প্রকার পাখিকে পোল্ট্রির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেমন হাঁস, মুরগি, টার্কি, কবুতর, তিতির, রাজহাঁস, কোয়েল ইত্যাদি।

পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য কৃষি বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যার ফলস্বরূপ অনেক উচ্চ ফলনশীল জাত যেমন ধান, গম, শাকসবজি, মাছ, গরু, মুরগির জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। অনুন্নত বিশ্বে উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাতের খাদ্যদ্রব্যের প্রতি এক প্রকার অনীহা আছে। যেটা মূলত কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণার কারণে হয়ে থাকে। অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারনা বেশি লালন করে বিধায় আমাদের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে এর প্রভাব অনেক বেশি। যেমন, আধুনিক ট্রাক্টরে চাষাবাদ করা উচ্চ ফলনশীল ধানে পুষ্টি কম, ফার্মের ডিমে পুষ্টি কম, ফার্মের মুরগি খেলে অসুখ বিসুখ হয়, উচ্চফলনশীল ফলমূলে ভিটামিন কম ইত্যাদি ভ্রান্ত ধারণা।

উচ্চ ফলনশীল জাতের প্রতি অনীহা থাকার কারণে এ সমস্ত পণ্যের বাজারজাতকরন ও সম্প্রসারণে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। এসমস্ত পণ্যের উৎপাদন বেশি ও চাহিদা কম থাকায় অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাওয়া যায় না। ফলে উচ্চফলনশীল জাতের সম্প্রসারণ অনেক বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা মেটাতে উচ্চফলনশীল জাতের বিকল্প নেই। তাই পজেটিভ প্রচারের মাধ্যমে ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে হবে। এক্ষেত্রে জনপ্রিয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ অনুকরণীয় ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।

উন্নত বিশ্বে বহু আগে থেকে উচ্চফলনশীল জাতের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছে। উন্নত বিশ্বের জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত হওয়ার কারণে উচ্চ ফলনশীল জাতের ওপর তাদের কোনো অনীহা নেই। তাদের দেশে সবই উচ্চ ফলনশীল জাতের বিধায় তাদের খাদ্য পুষ্টি কোনো ঘাটতি নেই। তারা অধিকতর সুস্বাস্থ্যবান জাতি সুতরাং  জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও তারা অনেকটাই এগিয়ে। এ কথা বলা বাহুল্য যে, কোন দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য শিক্ষিত সুস্বাস্থ্যবান নাগরিক অপরিহার্য।

ঠিক একইভাবে পৃথিবীর স্বনামধন্য পোল্ট্রি ব্রীডার কোম্পানিগুলো উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাতের মুরগির জাত উদ্ভাবন করেছে। পোল্ট্রি ব্রিডিং  এর অনেকগুলো  স্তর আছে, উপর থেকে নিচের দিকে আছে যেমন, Pedigree, GGP(great grand parents), GP(grand parents), Parents, Commercial (Broiler or Layer) ধাপে ধাপে ক্রস ব্রিডিং এর মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে আজকের বানিজ্যিক ব্রয়লার ও লেয়ার।

বাণিজ্যিক ব্রয়লার ও লেয়ার হল পোল্ট্রি ব্রিডিং এর সর্বশেষ পর্যায়, তাই এদের উৎপাদনশীলতা সবচেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে  মাংস উৎপাদনের জাতকে ব্রয়লার ও ডিম উৎপাদনের জাতকে লেয়ার বলা হয়। মূলত ব্রিডিং এর কারণে বাণিজ্যিক ব্রয়লারের দ্রুত বৃদ্ধি হয়, অথচ সাধারণ মানুষ মনে করে ফিডে হরমোন ও ক্ষতিকারক মেডিসিন ব্যবহারের কারণে এদের এত দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে । ব্রয়লার ফিড দেশি মুরগির বাচ্চাকে খাওয়ালে কিন্তু তাদের এত দ্রুত বৃদ্ধি হবে না। সুতরাং এতে বোঝা যায়, জেনেটিক্স এর কারনে এদের উৎপাদনশীলতা এত বেশি।

বাংলাদেশ পোল্ট্রিশিল্প পুরোটাই বিদেশনির্ভর, কারণ আমাদের নিজস্ব কোন ব্রিডিং লাইন নেই, মূলত বিদেশ থেকে গ্র্যান্ড প্যারেন্ট, প্যারেন্ট  আমদানি করে আমরা কমার্শিয়াল ব্রয়লার ও কমার্শিয়াল লেয়ার এর মাধ্যমে ডিম উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশ কাজী ফার্মস, প্রভিটা গ্রুপ, নাহার, নারিশ, প্যারাগন পোল্ট্রিশিল্পের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে।

উন্নত বিশ্বে ব্রয়লার মাংস Safe Meat হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়। উন্নত বিশ্বে ৬ সপ্তাহের আগে ব্রয়লার  জবাই করা হয় না, ছয় সপ্তাহ লালন-পালন করলে ব্রয়লার ৩ কেজির উপরে ওজন হয় ও মাংস পরিপক্ক হয়, তাই স্বাদে হয় অতুলনীয়। উইথড্রয়াল ফিড (প্রত্যাহার ফিড) খাওয়ানোর ফলে মানুষের জন্য ক্ষতিকর এমন কোন মেডিসিন ব্রয়লার মাংসে অবশিষ্ট থাকে না, এবং কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই, তাই ব্রয়লারকে নিরাপদ মাংস বলা হয়।

আমাদের দেশে এক সময় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কম ছিল বিধায় ১ কেজি ওজনের  ব্রয়লার মুরগি বাজারে বিক্রি করা হতো, এখন মানুষের  ক্রয় ক্ষমতা বাড়ার পরেও আগের মত ১ কেজি ওজনের ব্রয়লার বাজারে বিক্রি করা হয়। তাই আমাদের দেশের ব্রয়লারের মাংস অপরিপক্ক ও নরম হয়, তাই স্বাদ কম হয় বিধায় ব্রয়লারের প্রতি মানুষের অনীহা রয়েছে। তাই ব্রয়লার মুরগি ৬ সপ্তাহ লালন পালন করলে, একদিকে যেমন ব্রয়লার মাংসে স্বাদ বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে প্রত্যাহার ফিড খাওয়ানোর ফলে মাংসে এন্টিবায়োটিক এর কোন অস্তিত্ব থাকবে না, তাই আমরা একটু সচেতন হলে সহজলভ্য উপাদেয় নিরাপদ ব্রয়লার মাংস নিশ্চিত করতে পারি। এতে জনস্বাস্থ্যের প্রভূত উন্নতি সাধন হবে।

খাদ্যে ক্ষতিকর দ্রুতবর্ধনশীল ওষুধ ব্যবহারের যে কথা প্রচলিত আছে, তা অনেকটা অপপ্রচার। পোল্ট্রি খাদ্যে  ৯০% এর ও বেশি থাকে ভুট্টা, গম, চালের কুড়া, গমের ভুসি, ও সয়াবিন মিল ইত্যাদি। অন্যান্য উপাদানের মধ্যে থাকে এনজাইম ভিটামিন প্রিমিক্স, লাইমস্টোন, সয়াবিন তেল, টক্সিন বাইন্ডার, এসিডিফায়ার, অ্যামাইনো এসিড, লবণ ,DCP ও মিনারেল প্রিমিক্স ইত্যাদি। তাছাড়া ক্ষেত্র বিশেষে আরো থাকে Growth promotor ও Coccidiostat। পোল্ট্রিতে ব্যবহৃত coccidiostat মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। কারণ এই ড্রাগ মানুষের ব্যবহৃত হয় না বিধায় মানুষের ব্যবহৃত কোন এন্টিবায়োটিকের সাথে  ক্রস রেজিস্ট্যান্ট হয় না। অন্যদিকে এদের বেশির ভাগের প্রত্যাহার কাল 0 দিন। তাই এই ড্রাগ মুরগির মাংসে অবশিষ্ট থাকে না। এ সমস্ত ড্রাগ এর মধ্যে আছে মাদুরামাইসিন, সেলিনোমাইসিন, লাসালুসিড, মনিনসিন, এম্প্রোলিয়াম ইত্যাদি।

সুতরাং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ব্রয়লার লালন-পালন করলে মাংসের স্বাদ যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনিভাবে মানষে এন্টিবায়োটিকের কোন অবশিষ্ট থাকবে না। নিরাপদ মুরগির মাংস ও ডিম উৎপাদনের জন্য সরকারি নীতিমালা গ্রহণ করে শুধুমাত্র পোল্ট্রি নিউট্রিশনিস্ট ও ভেটেরিনারিয়ানদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এর পাশাপাশি পজিটিভ প্রচারণার মাধ্যমে বাংলাদেশের  জনগোষ্ঠী'কে এই সহজলভ্য মুরগির মাংস ও ডিম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

প্যানডেমিক সময়ে মানুষের  রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এন্টিবডি দরকার, আর এন্টিবডি তৈরি করতে দরকার আমিষ, এক্ষেত্রে সহজলভ্য ফার্মের ডিম ও মুরগির মাংসই হতে পারে প্রাণীজ আমিষের প্রধান উৎস। ব্রয়লার মাংস কে White Meat বলা হয়, এই মাংসের চর্বি কম ও এলার্জি সমস্যা নেই তাই সব বয়সের মানুষের জন্য উপকারী। হাস, গরু,ছাগল ও মহিষের মাংসে কমবেশি পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া থাকলেও, ব্রয়লার মাংস ও ডিমে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই ।

বিভিন্ন দেশে প্রতি বৎসর জনপ্রতি ব্রয়লার গ্রহনের হার বিশ্লেষণ করে সহজেই আমরা বুঝতে পারি যে ব্রয়লার মুরগি কত জনপ্রিয়। যেমন, সৌদি আরব-৪৩ কেজি, মালয়শিয়া-৪৬ কেজি, ইরান-২৭ কেজি, ইরাক-১৫ কেজি, ব্রনাই-৬২.৯ কেজি, ইন্দোনেশিয়া-৮ কেজি, ওমান-২১ কেজি। আবার অমুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে ব্রয়লার মুরগির মাংস গ্রহণের পরিমাণ আরো বেশি। কিন্তু দেখা যায় যে বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং ৯০ শতাংশ মুসলমান বাস করে অথচ মুরগির মাংস গ্রহণ করে মাত্র ৬ কেজি প্রতি জন প্রতি বৎসর।

অন্যদিকে ডিমের পুষ্টিগুনের কথা বলে শেষ করা যাবে না। ডিম হল সুষম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন একটি ন্যাচারাল ফাস্টফুড। ডিম খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি সহজপাচ্য। ডিম সব বয়সের মানুষ খেতে পারে। ডিমের কুসুমে চর্বি থাকলেও এটি উপকারী চর্বি অর্থাৎ HDL.আমাদের মনে রাখতে হবে সব ধরনের চর্বি শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয় বরণ চর্বি হলো খাদ্য উপাদানের অন্যতম প্রধান উপাদান। চর্বি মস্তিষ্কের খাদ্য এবং শক্তির অন্যতম উৎস। আমাদের সমাজে একটি ধারণা প্রচলিত আছে ফার্মের ডিমে কোন পুষ্টি নেই, আসলে পুষ্টির পরিমাণ নির্ভর করে ডিমের সাইজের উপর। দেশি মুরগির ডিম ও ফার্মের ডিমের মধ্যে পুষ্টিগুণের কোন তারতম্য নেই।

জাপানিদের গড় আয়ু পৃথিবীতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (৮৫.০৩ বছর) তারা বছরে গড়ে ৩২০ টি ডিম খায়। চীনারা গড়ে ৩৮০ টি ডিম খায়। সেখানে বাংলাদেশীরা বছরে গড়ে ১০৪ টি ডিম খায়। বাংলাদেশের ডিমের উৎপাদন লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেলেও অপপ্রচারের কারণে ডিম গ্রহণের হার পৃথিবীতে নিম্ন  সারিতে আছে ।

পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্র গুলির দিকে তাকালে বুঝা যায় পোল্ট্রি মাংস ও ডিম গ্রহণে আমরা কত পিছিয়ে আছি। তাই এখনই সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে অপপ্রচার বন্ধ করে পোল্ট্রি মাংস ও ডিম গ্রহণের হার বাড়ানো এবং পোল্ট্রি শিল্পকে রক্ষা করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা।

লেখক:সহকারী মহাব্যবস্থাপক, প্রভিটা গ্রুপ।