বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষকরা টানা তৃতীয় বছর সফলভাবে আলু রপ্তানি করছে

এগ্রিলাইফ২৪ ডটকম:দেশের উত্তরাঞ্চল রংপুর- যা এক সময় মঙ্গাপীড়িত বলে পরিচিত ছিল, সেখানে এখন উৎপাদিত হয় বাংলাদেশের কোটি টনের এক চতুর্থাংশ আলু। শুধু তাই নয়; রংপুরের কৃষকরা উত্তম চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করে উৎকৃষ্ট আলু উৎপাদন করে রপ্তানি বাজারে সম্পৃক্ত। এতে করে তারা অতি উৎপাদনের ক্ষতি পুষিয়ে তাদের আয় বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।

টানা তৃতীয় বারের মত এবারও চারটি উৎপাদনকারী সংগঠন একত্রিত হয়ে মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে এ বছরের আলু রপ্তানি উৎসব পালন করেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব মো: সায়েদুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে আলু রপ্তানি উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জনাব মো: বেনজীর আলম, মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাগণ, আলু উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকগণ এবং সাংবাদিকবৃন্দ উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
 
সরাসরি কৃষকের মাঠ থেকে আলু রপ্তানির এই সফলতার পিছনের শক্তি হলো সামগ্রিক কর্মকৌশল ও অংশীদারীত্ব। ‘মিসিং মিডল ইনিশিয়েটিভ (এম এম আই)’ প্রকল্পের আওতায় উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গে বিস্তৃত ৫৫টি সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংগঠন সারা বাংলা কৃষক সোসাইটি (এস বি কে এস) এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফ এ ও)-র অংশীদারিত্বে এই সফল উদ্যোগের সূচনা। তবে কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএডিসি ও রপ্তানিকারকরা এই উদ্যোগের সক্রিয় কুশীলব, তাদের সহযোগিতায় এই সফলতা।  
 
প্রকল্পের উদ্যোগে ৪টি আলু উৎপাদনকারী সংগঠনের ১০০ জন কৃষককে যাদের অর্ধেকের বেশি নারী ‘উত্তম চাষাবাদ পদ্ধতি’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে প্রতিবারের মত এবারও এফএও উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকদের বৈঠকের ব্যবস্থা করে। বীজ সংগ্রহ, মূলধন যোগান, মাটি পরীক্ষা, পরিদর্শন, ফলনোত্তর সংরক্ষণ, প্রশিক্ষণ সবকিছুকে সমন্বিত করে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ আলু রপ্তানিকারক এসোসিয়েশন (বিপিইএ) এবং এসবিকেএস এর উদ্যোগে মুখোমুখি বৈঠকের ফলস্বরূপ উৎপাদনকারীরা রপ্তানিকারক কর্তৃক সরবরাহকৃত ‘সান্তনা’ জাতের বীজ থেকে ৪৫০ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন করেছে। পাশাপাশি উৎপাদনকারীরা ডায়ামন্ট, কার্ডিনাল, গ্রানোলা এবং এসটেরিক্স জাতের আলুও উৎপাদন করেছে। রপ্তানিকারকদের তথ্য মতে মালয়েশিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলিতে এই আলুর বিশেষ চাহিদা বিদ্যমান।  
 
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান মতে এ বছর ৪,৮০,০০০ (চার লক্ষ আশি হাজার) হেক্টর জমিতে ১১ মিলিয়ন মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হবে। স্থানীয় চাহিদা ৭.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন। মোট উৎপাদনের ২৩-২৫% কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণ করা যায়। ফলনোত্তর ক্ষতি ও অতিরিক্ত উৎপাদনে আলু চাষীদের ক্ষতি টাকার অংকে প্রায় ২৫৩৫ বিলিয়ন (২৯০-৪০০ মিলিয়ন ডলার)।
 
অতিরিক্ত উৎপাদনের অভিশাপ থেকে কৃষকদের মুক্তির লক্ষ্যে সরকার রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দিচ্ছে। যদিও এখনো অনেক প্রতিক‚লতা বিরাজমান যেমন আমদানীকারক দেশের রপ্তানি বিষয়ক শর্ত পূরণ, পছন্দসই জাতের ঘাটতি, কৃষকদের চাহিদামত মানসম্পন্ন বীজের অভাব। এছাড়াও কৃষক পর্যায়ে হোলো হার্ট, বাদামী পঁচা রোগ, নেমাটোড, পোকামাকড়  মুক্ত পরিচ্ছন্ন চাষাবাদের উৎসাহ ও পরীক্ষার অভাব বিদ্যমান।  
 
এসব বিপত্তি অতিক্রমে সরকার বাংলাদেশের জন্য উত্তম চাষাবাদ (বাংলা জিএপি) পদ্ধতি নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে। স্যানিটারি ও ফাইটোস্যানিটারি শর্তাবলী পূরণের লক্ষ্যে এফএও এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে উন্নতমানের পরীক্ষাগার স্থাপনের কাজ দ্রæত এগিয়ে চলছে। আশা করা যায় অচিরেই এর ফলে আলু ছাড়াও অন্যান্য সবজি রপ্তানিতে জোয়ার আসবে।
 
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব মোঃ সায়েদুল ইসলাম বলেন, “আমি এফএও এর মিসিং মিডল ইনিশিয়েটিভ এবং ডিএই, বিএডিসি, আলু রপ্তানিকারক সমিতি (বিপিইএ) এবং উৎপাদনকারী সংগঠনগুলোর যৌথ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে আলু রপ্তানি মূল্যসংযোজন ধারাকে শক্তিশালী করার জন্য তাদের প্রশংসা করি। তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের উন্নয়নে সকলের একসাথে কাজ করতে হবে।”
 
বাংলাদেশে এফএও প্রতিনিধি রবার্ট ডি সিম্পসন বলেন, “সত্যিকার অর্থে উন্নতির জন্য আলু রপ্তানি মূল্যসংযোজন ধারায় সরকার, বেসরকারি খাত এবং উৎপাদনকারী সংগঠনের মধ্যে একটি কার্যকর জোট প্রয়োজন। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ও রপ্তানি চাহিদা সম্পন্ন জাতের আলুর প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আমরা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে আলু রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য জিএপি নীতিমালার আওতায় উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া মানসম্মতকরণ, স্যানিটারি এবং ফাইটো স্যানিটারি নিয়মাবলী অনুসরণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি।”


 
প্রকল্পটি আলু উৎপাদনকারী সংগঠনগুলো তাদের উপকরণ ক্রয় এবং উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় করার জন্য ভার্চুয়াল কল সেন্টার চালু করতে সহায়তা করেছে। বিরহিম আইএপিপি কৃষক সমবায় সমিতি লিমিটেডের ভার্চুয়াল কল সেন্টার অপারেটর সালমা আক্তার আদুরী বলেন, “আমি রপ্তানিকারকদের কাছে আমাদের সান্তানা জাতের আলুর ছবি পাঠিয়েছি। রপ্তানিকারকরা উৎকৃষ্ট মানের আলু দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। আমরা উৎপাদনকারী সংগঠন সমূহ দু’জন রপ্তানিকারকের কাছ থেকে ২০০ মেট্রিক টনেরও বেশি সরবারহের অর্ডার পেয়েছি”।
 
একটি কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং রপ্তানিমুখী কোম্পানি মাসাওয়া কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব আরিফ আজাদ প্রিন্স বলেন, “সরকার, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, রপ্তানিকারক এবং উৎপাদনকারী সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি শক্তিশালী রপ্তানি সরবরাহ মূল্যসংযোজন ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “আলু উৎপাদনকারী সংগঠনগুলো উত্তম চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করে মানসম্পন্ন আলু উৎপাদন করে এবং সেগুলো একত্রীকরণ করে আমাদের কোম্পানির কাছে বিক্রয় করে। আমরা কৃষকদের ন্যায্য মূল্য প্রদান করি এবং আমাদের আমদানিকারকরা প্রত্যাশা অনুযায়ী মানসম্পন্ন আলু পায়। ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের আলুর সুখ্যাতি বাড়ছে।