বিশ্ব দুগ্ধ দিবস'২০২১-কমাতে হবে আমদানী নির্ভরতা

Category: বিজনেস ও ইন্ডাস্ট্রি Written by agrilife24

রাজধানী প্রতিনিধি:বেশী বেশী দুধ থান এবং দুগ্ধ জাতীয় পন্য শিশুর মেধা বিকাশ ও সুস্থ ভাবে বেড়ে ওঠার অন্যতম হাতিয়ার। করোনা প্রতিরোধে নিজেকে সুস্থ রাখতে প্রতিদিন একগ্লাস দুধ নিজে পান করুন, পরিবার ও আত্মীয় স্বজনকে দুধ পানে উৎসাহিত করুন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনি নানা শ্লোগানে আজ মঙ্গলবার ১ জুন সারা দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস'২০২১। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, "Sustainability in the dairy sector with messages around the environment, nutrition and socio-economicsু." । করোনার কারণে এ দিবসটি পর্দার অন্তরালে চলে গেলেও এর গুরুত্ব কিন্ত অনেক।

চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যর্থতার নেপথ্যে গো-খাদ্যের সঙ্কট ও উচ্মূল্য, উৎপাদিত দুধ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণসহ নানান সঙ্কটের কথা বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তবে সব সঙ্কট কাটিয়ে আগামী ৫ বছরের মধ্যে দুধের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং এর আওতাধীন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান। দুধ পাওয়ার পর সেটি যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করে বড় কোম্পানিগুলো। কিন্তু খামারি পর্যায়ে এ বিষয়ে ধারণা কম থাকায় এবং ব্যবস্থাপনা না থাকায় যথাযথভাবে এই দুধ সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। খামারি পর্যায়ে মেশিনারিজের অভাবে অনেক সময় দুধটা আমাদের কাছে পৌঁছায় না। আবার গুঁড়ো দুধের দাম কমে গেলে কৃষক বাইরে দুধ বিক্রি করতে পারে না।’ এসব সমস্যা সমাধানে দুধ উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য বিভাগভিত্তিক প্রসেসিং প্লান্টের ব্যবস্থা ককরার কথা বলেছেন উদ্যোক্তারা।

দেশে দুধ উৎপাদন বাড়লেও সে অনুযায়ী প্রক্রিয়াজাত কারখানা বাড়ছে না। দুধের চাহিদা বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে গুড়া দুধ আমদানিও। জানা যায়, প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার দুধ আমদানি করা হয়। দেশীয় দুধের উৎপাদন খরচ বেশি বলে আমদানি করা হচ্ছে। এটা সমন্বয় করা না গেলে খামারি, প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান কিংবা ভোক্তা কেউই উপকৃত হবে না। খামারীরা বিনিয়োগ করে লাভ করতে পারছে না। দেশীয় এই শিল্পকে সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের সহযোগিতা করা দরকার বলে মনে করেন প্রান্তিক পর্যায়ের খামারীরা। গো-খাদ্যে ভ্যাট-ট্যাক্স কমানো, দুধ আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা, এই জিনিসগুলো করা এখন সময়ের দাবী।

দুধ উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, দুধ ক্রয়কেন্দ্রের পরিধি বৃদ্ধি, দুধ বিপণন সহজ করা, উন্নত প্রযুক্তির পাউডার প্লান্ট ও চিলিং প্লান্টের ব্যবস্থা করা, প্রতিটি বিভাগে অন্তত একটি করে পাউডার প্লান্ট করার ব্যবস্থা গ্রহনের ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা দরকার আছে। ভালো জাতের গবাদিপশু আমদানির পাশাপাশি দেশীয় জাতের উন্নয়ন করার কথা বলেছেন অনেক উদ্যোক্তারা। গোখাদ্য যদি খামারিদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে না থাকে, তাহলে তারা দুধ উৎপাদনে আগ্রহ হারাবে। এর পাশাপাশি গবাদিপশুর ভ্যাকসিনেশন, ওষুধ সব কিছুই খামারীদের নাগালের মধ্যে রাখতে হবে এবং তাদের ব্যাপক হারে প্রণোদনা দিতে হবে।

এদিকে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস ২০২১ দিবসে লাইভস্টক ডিপার্টমেন্টের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অনেকে। দুগ্ধ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে দুগ্ধ উৎপাদনে জড়িত প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এর পাশাপাশি দেশীয় দুগ্ধ শিল্প টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তিনি গুঁড়া দুধের উপর আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ খামারীও শিল্পোদ্যাক্তারা। সঠিকভাবে প্রচারণার মাধ্যমে দুধের পুষ্টিগুণ গুলো নিয়মিত ভোক্তাদের সামনে উপস্থাপন করা উচিত বলে মনে করেন তারা। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সকল সংস্থাগুলো এগিয়ে আসা দরকার বলে মনে করেন ষ্টেক হোল্ডাররা।

বিশ্ব দুগ্ধ দিবস ২০২১ উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ-এর মহাসচিব কৃষিবিদ খায়রুল আলম প্রিন্স। শুভেচ্ছায় তিনি বলেন, দুধ পুষ্টির একটি অন্যতম উৎস। মেধা বিকাশে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়াও দেশের কৃষি অর্থনীতিতে দুধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দখল করে আছে। কাজেই দুগ্ধ উৎপাদনে যারা জড়িত তাদের কথা এখন বেশি করে আমাদের ভাবতে হবে।

বিএলআরআই-এর মহাপরিচালক ডঃ মোঃ আব্দুল জলিল বলেন, দুধের কোনো বিকল্প নেই, অদূর ভবিষ্যতে ল্যাকটোজ ফ্রী দুধ উৎপাদন করার জন্য তাদের প্রতিষ্ঠান গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।

ঢাকা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: কাজী রফিকুজ্জামান বলেন, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে দুধ সকল মানুষের জন্য মজাদার, পুষ্টিকর এবং সুষম খাদ্য। তিনি বলেন, দুধের তৈরি বিভিন্ন পন্যের বহুমুখী ব্যবহারের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তারা। বিশ্ব দুগ্ধ দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম এর ডিএলও, ডা: রেয়াজুল হক বলেন, দুগ্ধ সম্পর্কে সঠিক বার্তা না থাকার কারণে অনেক মানুষ দুধ থেকে নিজেদের দূরে রাখে। দুধ থেকে উৎপাদিত টক দই এবং পনিরে উপকারী ব্যাকটেরিয়া উপস্থিত থাকায় তা স্ব্যাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। তিনি আরো জানান শিশু এবং অল্প বয়সী সকলের জন্য হোল মিল্ক এবং বৃদ্ধ লোকদের জন্য স্কিম মিল্ক উপযুক্ত খাবার।

দেশের এগ্রি বিজনেসের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি এসিআই এগ্রিবিজনেস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এফ এইচ আনসারি বলেন, বাংলাদেশে দুগ্ধ সরবরাহের সীমাবদ্ধতা রয়েছে আমদানি নির্ভর হওয়ার কারণে। যদিও দেশে প্রানীর সংখ্যা অনেক বেশি কিন্তু দুগ্ধ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক কম হওয়ায় এর চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, দেশীয় জাতগুলোকে উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত জাতে রুপান্তরের মাধ্যমে দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব। যার ফলে দেশের খামারীগণ ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন। তিনি বিশ্ব দুগ্ধ দিবস উপলক্ষে তিনি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয়, খামারী, সরকারি-বেসরকারিভাবে এই শিল্পের সাথে জড়িত সকলকে শুভেচ্ছা এবং ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

রেনাটা এনিমেল হেলথ এর পরিচালক ও প্রধান জনাব সিরাজুল হক বলেন, বাংলাদেশে সুষম খাদ্যের অন্যতম খাদ্য উপাদান হলো দুধ এবং ডিম। প্রানীজ আমিষ হিসেবে গ্রামগন্জ থেকে সকল জায়গায় দুধ সহজলভ্য হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা ও অনেক বেশি। তিনি আরো জানান, সরকারের আন্তরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমদানি নির্ভর ডেয়রী শিল্প থেকে দেশীয়ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ন হওয়া সম্ভব।

কভিড-১৯ দেশের দুগ্ধ ও মাংস শিল্পকে ভীষনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আজকে দুগ্ধ বিশ্ব দিবসে আমাদের সকলের চাওয়া যেন আমরা দ্রুত এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারি। দেশের দুগ্ধ খামারিরা আবার প্রান ফিরে পাক, জনগনের মাঝে সচেতনা বৃদ্ধি হোক। করোনার সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হলে পরিবারের সকলের দুধ পান অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এমনটাই আশা করেন Bangladesh Dairy Farmers' Association-এর মহাসচিব জনাব শাহ এমরান।

গত এক দশকে বাংলাদেশে ডেইরী শিল্পে এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। উন্নত জাতের গাভী, আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনা, তরুণ ও শিক্ষিত উদ্যোক্তাদের হাত ধরে দুধ উৎপাদনে শীঘ্রই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে দুধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্যসামগ্রী বাজারজাতকরনে এখনো অনেক পিছিয়ে আছি আমরা। যার ফলে অনেক সময় খামারীরা তাদের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সারাদেশে তরল দুধের সরবরাহ, সংরক্ষন ও পরিবহনে গুরুত্ব সহকারে কাজ করলে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করেন জেনারেল সেক্রেটারী, দি ভেট এক্সিকিউটিভ ও বঙ্গবন্ধু ভেটেরিনারি পরিষদ-এর  মহাসচিব কৃষিবিদ ডা. সাইফুল বাসার।

উল্লেখ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এ বছর দেশব্যাপী দিবসটি পালন করছে। এর অংশ হিসেবে ১ জুন থেকে ৭ জুন পর্যন্ত দুগ্ধ সপ্তাহ পালিত হবে।