আসমি-বাংলাদেশ প্রকল্পের উদ্যোগে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বিষয়ক সেমিনার ও মেলা অনুষ্ঠিত

Category: সমসাময়িক Written by agrilife24

কৃষিবিদ দীন মোহাম্মদ দীনু, বাকৃবি,ময়মনসিংহ: কৃষক, কৃষি উদ্যোক্তা, ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগ পরিচালিত এপ্রোপ্রিয়েট স্কেল মেকানাইজেশন ইনোভেশন হাব (আসমি)-বাংলাদেশ প্রকল্প এর আয়োজনে এবং ফুলপুর উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বিষয়ক সেমিনার ও কৃষি যন্ত্রপাতি মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে আজ মঙ্গলবার (১৪ জুন) সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ০৫ টা পর্যন্ত কৃষি যন্ত্রপাতি মেলা চলে। মেলা চলাকালীন সময়ে ফুলপুর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে সকাল ১০ টায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বিষয়ক সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর এর কিউরেটর, বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব-১ জনাব মোঃ নজরুল ইসলাম খান।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের প্রফেসর এবং আসমি-বাংলাদেশ প্রকল্পের সহযোগী প্রকল্প পরিচালক ড. চয়ন কুমার সাহা এর সঞ্চালনায় এবং  বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এর কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের প্রফেসর ও প্রকল্প পরিচালক (আসমি-বাংলাদেশ) ড. মোঃ মঞ্জুরুল আলম এর সভাপতিত্বে সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক জনাব তারিক মাহমুদুল ইসলাম, ময়মনসিংহ জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক জনাবা উম্মে হাবিবা, ফুলপুর উপজেলার  উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব আতাউল করিম রাসেল।

প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ফুলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মি: শীতেষ চন্দ্র সরকার। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আসমি- বাংলাদেশ প্রকল্পের রিসার্চ কোঅর্ডিনেটর প্রফেসর ড. মোঃ রোস্তম আলী। এছাড়াও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ফুলপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা জনাব মোঃ আবদুল্লাহ আলমামুন, সফল উদ্যোক্তা জনাব মোঃ নিলয়, খোদেজা খাতুন ও জনাব মোঃ নজরুল ইসলাম। ।

আলোচনা সভায় বক্তাগণ বলেন, বাংলাদেশের কৃষি কাজের প্রতিটি ধাপে লাগসই কৃষি যন্ত্রের প্রয়োগ খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। ধান উৎপাদনে রোপনের সময় শ্রমিক সংকটসহ শ্রমিকের বাড়তি মজুরী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি করে অপরদিকে উৎপাদন ব্যাহত করে। আরেকদিকে, আমাদের দেশে সনাতন পদ্ধতিতে অসংখ্য শ্রমিকের কাঠোর পরিশ্রমে, বহু শ্রম ঘন্টার বিনিময়ে ধান কাটা, মাড়াই-ঝাড়াই করা হয়। এরপরেও ফসল কাটার মৌসুমে ঝড়, শিলাবৃষ্টি, পাহাড়ী ঢল ও অকাল বন্যার শঙ্কা থাকে। ফলে সৃষ্টি হয় শ্রমিকের তীব্র সংকট, মজুরী বেড়ে যায় কয়েকগুন; ধানের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় এবং সমূহ ক্ষতির মুখে পড়ে কৃষক।

বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে খামার যান্ত্রিকীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। এক্ষেত্রে দেশের টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে কৃষি যন্ত্রায়ণের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের কৃষিতে গতিশীলতা আনয়নে কৃষি যন্ত্রের বিস্তারের বিকল্প নেই। মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধনকল্পে কৃষি উৎপাদনে যেমন যন্ত্রের ব্যবহার সময়ের দাবী ঠিক তেমনই উৎপাদিত শস্যের প্রক্রিয়াজাতকরণে বিশেষতঃ শস্য শুকানো  এবং শস্য সংরক্ষণ পদ্ধতিতেও যন্ত্র প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যাবশ্যক।

সম্প্রতি বাংলাদেশে লাগসই কৃষি যন্ত্রপাতি জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র দুরদৃৃষ্টিসম্পন্ন নির্দেশনায় এবং মাননীয় কৃষি মন্ত্রী জনাব ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এমপি মহোদয়ের সুযোগ্য নেতৃত্বে অনুমোদিত ৩০২০ কোটি টাকার “সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ” শীর্ষক একটি মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে বিশেষ ভর্তূকির ভিত্তিতে কৃষকদের মাঝে চারা রোপণের যন্ত্র বা ট্রান্সপ্লান্টার, শস্য কর্তনের যন্ত্র রিপার ও কম্বাইন হারভেস্টার, মাটির গুনাগুন রক্ষাকারী বীজ বপন যন্ত্র এবং শস্য শুকানো যন্ত্রসহ প্রয়োজনীয়তার নিরিখে অন্যান্য যন্ত্র প্রদান করা হচ্ছে।

মেলায় মোট ০৭ (সাত) টি স্টলে এসিআই মটরস্ লি., দি মেটাল (প্রা.) লি., আবেদীন ইকুইপমেন্ট লি., এসকিউ গ্রুপ, বাংলা মার্ট লি., এগ্রোমেক ডেভেলপমেন্ট ইনিসিয়েটিভ ও আসমি-বাংলাদেশ প্রকল্প অংশগ্রহণ করে। এসব প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত ও প্রস্তুতকৃত এবং আমদানীকৃত চারা রোপন যন্ত্র, ফসল কর্তন ও সংগ্রহ যন্ত্র, মাড়াই-ঝাড়াই যন্ত্র, সার-কীটনাশক ছিটানো যন্ত্র, স্মার্ট ইরিগেশন টেকনোলজী, আই্ওটি কৃষি যন্ত্রপাতি, শস্য শুকানোর বাউ-এসটিআর ড্রায়ারসহ বিভিন্ন প্রকার কৃষি যন্ত্রপাতি প্রদর্শন করে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ফিড দি ফিউচার প্রোগ্রামের আওতায় ইউএসএইড এবং এপ্রোপ্রিয়েট স্কেল মেকানাইজেশন কসসোর্টিয়াম (এএসএমসি), ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র এর অর্থায়নে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এপ্রোপ্রিয়েট স্কেল মেকানাইজেশন ইনোভেশন হাব (আসমি)-বাংলাদেশ নামে একটি গবেষণা প্রকল্প বাংলাদেশে দুই মেয়াদে (অক্টোবর ২০১৫ হতে সেপ্টেম্বর ২০১৯ এবং জুলাই ২০২০ হতে জুন ২০২৩ পর্যন্ত) পরিচালনা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য গবেষণার মাধ্যমে চাহিদামত উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করে ফসলের মূল্য নির্ণয়ে সময়, শ্রম ও অর্থ সাশ্রয়ের জন্য লাগসই যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এই গবেষণার মূল লক্ষ্য। দুই মেয়াদে প্রকল্পটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের চারটি জেলার (খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও নোয়াখালী) চার (০৪) টি উপজেলা (ডুমুরিয়া, উজিরপুর, কলাপাড়া ও সুবর্ণচর) নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।

উল্লেখিত এলাকাগুলির উপযোগী ধানের চারা রোপনযন্ত্রের জন্য উপযুক্ত ধানের চারা উৎপাদন ও ধানের চারা রোপন যন্ত্র পরিচালনা, বিভিন্ন ফসলের জন্য বীজ বপন যন্ত্রের উপযোগীতা ও ব্যবহার, ফসল (ধান) কর্তনের জন্য রিপার ও কম্বাইন হারভেষ্টার এর উপযোগিতা পরীক্ষাসহ কৃষকদের নিকট জনপ্রিয়করণ, অপারেটর ও মেকানিকদের প্রশিক্ষণ প্রদান দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ এবং যন্ত্রগুলোর প্রতি কৃষক ও উদ্যোক্তাদের আগ্রহ সৃষ্টিতে প্রকল্পটি কাজ করেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট প্রকল্পের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গবেষণা কাজে সর্বতো অংশগ্রহণসহ সার্বিকভাবে গবেষণার কাজে যুক্ত থেকেছে। এছাড়াও এসিআই মটরস্ লিমিটেড ও মেটাল প্রাইভেট লিমিটেড প্রকল্পের সাথে কারিগরী সহায়তা দিয়ে প্রকল্পের গবেষণার কাজে সহায়তা প্রদান করেছে।

প্রকল্পটির গবেষণা কাজে প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থাপনা সহায়তা করেছে সাসটেইনেবল ইনটেনসিফিকেশন ইনোভেশন ল্যাব (সিল), আমেরিকার কানসাস স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়। প্রকল্পটি নারীর ক্ষমতায়ন, উদ্যোক্তা তৈরী, কৃষকদের সংগঠিত করা, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নসহ ভবিষ্যত কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী সংস্থাসমূহের করণীয় নির্ধারণে নীতিনির্ধারণী  বিষয়সমূহ চিহ্নিতকরণে কাজ করেছে। বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য অঞ্চলভিত্তিক উপযোগী লাগসই কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন, আধুনিক ধানের চারা রোপণের যন্ত্র বা ট্রান্সপ্লান্টার, কম্বাইন হারভেস্টার ও মাটির গুনাগুন রক্ষাকারী কৃষি যন্ত্র (বীজ বপন যন্ত্র, বেড প্লান্টার) এবং এক্সিয়াল ফ্লো পাম্প ও সোলার পাম্প ইত্যাদি কৃষি যন্ত্রপাতি চিহ্নিতকরণে বিশেষ কার্যকর সমাধান হতে পারে আসমি-বাংলাদেশ প্রকল্প।