আমার এক একটি ছাত্র বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য তাই আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী

Category: সমসাময়িক Written by agrilife24

গভ: ল্যাবরেটরি’র জিক স্যারের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
সমসাময়িক ডেস্ক:গত ১ এপ্রিল রাজধানীর ধানমন্ডি ক্লাবে অনুষ্ঠিত হলো গভ: ল্যাবরেটরি স্কুলের সাবেক শিক্ষক মুহাম্মদ জহুরুল ইসলাম খান (জিক) স্যারের আত্ম-জীবনীমূলক গ্রন্থ “গবঃ ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, ইতিহাস ও আত্মকথা” এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খালেদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিশিষ্ট শিল্পপতি নাজমুল আহসান খালেদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন শিক্ষক মুহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব, ঢাকার সাবেক জেলা প্রশাসক, বিআরটিএ এর সাবেক চেয়ারম্যান এবং বিমান বাংলাদেশ এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এম এ মোমেন; ওল্ড ল্যাবরেটরিয়ান্স এসোসিয়েশন (ওলসা) এর সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোসাদ্দেক আজম সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও ব্যবসায়ী আবু সাঈদ।   

সূচনা বক্তব্যে ল্যাব ৮৪ ব্যাচের ছাত্র নারিশ গ্রুগ্পের পরিচালক শামসুল আরেফিন খালেদ (অঞ্জন) বলেন, “যিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের শক্তি ও দুর্বলতা, আনন্দ-বেদনা আর সৃজনশীলতার মধ্যে খুঁজে ফিরেছেন নিজেকেই- তিনি আর কেউ নন,  শিক্ষার্থীদের অতিপ্রিয় মুখ সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুহাম্মাদ জহুরুল ইসলাম খান (জিক) স্যার। আজ আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি এমন এক অসাধারণ গ্রন্থের মোড়ক উন্মচনকে ঘিরে যা কিনা সেই অসাধারণ মানুষটির এক অনন্য স্মৃতি আলেখ্য হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্য পথনির্দেশ হয়ে থাকবে”।



অঞ্জন বলেন, আমরা আমাদের শিক্ষকদের কাছে ঋণী যাঁরা আমাদের নৈতিকতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, প্রচার বিমুখতা ও ভেঙে না পড়ার শিক্ষা দিয়েছেন। স্কুলে পড়া অবস্থায় আমরা হয়তো অনেকেই তা উপলব্ধি করতে পারিনি। কিছুটা আক্ষেপের সুরে অঞ্জন বলেন, আমাদের স্কুল তাঁর স্বর্ণযুগ পার করে হয়তো ব্রোঞ্জ যুগে প্রবেশ করেছে, যা আমাদের মনঃকষ্টের কারণ। আমরা আমাদের স্কুলের ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় আছি। অঞ্জন বলেন, আমি আশা রাখবো, Face Book কিংবা Fake Book এর এই জামানায়, "গভ: ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ইতিহাস ও আত্মকথা" এই Real Book থেকে আমরা শিক্ষা নেব। গভ: ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের আবার ঘুরে দাড়ানোর শিক্ষা; নতুন প্রজন্মকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে এবং প্রিয় মাতৃভূমিকে সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষা নিতে হবে আমাদের।

গভ: ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক মুহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব বলেন- বই পড়ে বর্তমান ছাত্ররা এবং সাবেক শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যরা ঐতিহ্যবাহী এ স্কুলের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক বিষয়ে জানতে পারবে। তিনি বলেন, জিক স্যার অত্যন্ত দায়িত্ববান একজন মানুষ ছিলেন। ছাত্রদের কাছে জিক স্যার অত্যন্ত শ্রদ্ধার এবং প্রিয়ভাজন মানুষ ছিলেন। স্কুল ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে প্রত্যেক শিক্ষকের সাথেও তাঁর সম্পর্ক অত্যন্ত আন্তরিক ছিল। গভ: ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক খান মোহাম্মদ সালেক স্যারের নামে এবং তাঁর আদর্শ ও চেতনাভিত্তিক একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সাবেক ছাত্রদের প্রতি আহবান জানান।  

ড. এম এ মোমেন বলেন, সত্তর এর দশকে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিদ্যালয়ের শিষ্টাচার, নীতি-নৈতিকতা কিরূপ ছিল তা জানতে হলে এ বইটি পড়তেই হবে। তিনি বলেন, জিক স্যারের পরিবার তাঁকে সহযোগিতা করেছেন বলেই এতটা নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা নিয়ে তিনি তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন।

ড. মোমেন তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ৭৩ ব্যাচের ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় জীববিজ্ঞানে কেউই লেটার মার্কস পায়নি। ছাত্ররা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। পাশে দাঁড়িয়ে জিক স্যারও তখন একইভাবে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি সে সময়ের ছাত্রদের ভক্তি ও শ্রদ্ধা এতটাই প্রকট ছিল যে ঢাকার জেলা প্রশাসক হিসেবে তৎকালীন মন্ত্রীর সাথে এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনে এসেও তিনি সরকারি পদমর্যাদা না দেখিয়ে অভদ্রতা হবে ভেবে একজন সাবেক ছাত্র হিসেবেই শ্রেণীকক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।



অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি বিশিষ্ট শিল্পপতি, খালেদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল আহসান খালেদ বলেন, আমি গভ: ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র না হলেও আমার পুরো পরিবার এ প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত, আমার দুই ছেলে এ স্কুলের শিক্ষার্থী, একমাত্র মেয়ে জিক স্যারের ছাত্রী। তিনি বলেন, গভ: ল্যবরেটরি স্কুল শুধু যে ভাল রেজাল্টই করে তাই নয়, তাঁরা ভাল মানুষও তৈরি করে। আমরা শিক্ষকদের কাছে ঋণী আমাদের ছেলেমেয়েদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। জহুরুল ইসলাম খান স্যার তাঁর বইতে যা কিছু লিখেছেন, যা কিছু বোঝাতে চেয়েছেন- এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে এমনটাই আমার প্রত্যাশা।

অনুষ্ঠানের সভাপতি আমেরিকা প্রবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবু সাঈদ বলেন, গভ: ল্যাবরেটারি স্কুল আমার কাছে বটগাছের মত। আমরা সবাই সে গাছের এক একটি পাতা। অনেক পাতা ঝরে গেছে, তাঁদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। আবু সাঈদ বলেন, জিক স্যারের বইটি যেন একটি ম্যাজিক বুক, অনেকটা জাপানিজ মুভির মত যেখানে Facts এবং Perspective কে আলাদা করা মুশকিল। এর ভেতর দিয়ে স্যার আমাদের জন্য যেন একটি Memory Lane তৈরি করে দিয়েছেন।

“গভ: ল্যাবরেটরি স্কুল ইতিহাস ও আত্মকথা” আত্ম-জৈবনিক গ্রন্থের লেখক মুহাম্মদ জহুরুল ইসলাম খান (জিক) স্যার বলেন, আমার মতে প্রতিটি ছাত্রই By born genius শুধুমাত্র তাঁদের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাগুলোকে জাগিয়ে তোলার জন্য একটু চেষ্টা করলেই আপাত অসম্ভবটি বাস্তবে রূপ নেয়। আমাদের দেশে একজন শিক্ষকের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা কতটুকু তা সকলেই জানেন কিন্তু আমি বলি আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষদের একজন কারণ আমার এক একটি ছাত্র বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। ওদের কারণেই আমি গৌরবান্বিত, আনন্দিত, পরিতৃপ্ত। একজন শিক্ষকের সফলতা সেখানেই যখন তাঁর ছাত্ররা তাঁকে ডিঙ্গিয়ে ওপরে উঠে যায়।

আমার ছাত্ররা ইউরোপ আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে; দেশের ভেতরে মর্যাদাপূর্ণ উচ্চ আসনগুলোতে অধিষ্ঠিত তারা। আমার আর কী চাই? ওরা সকলেই এখন অনেক বড় হয়েছে কিন্তু আজও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনা, মাথা নিচু করে থাকে যেন এখনও সেই সিক্স সেভেনের ছাত্র। এ শিক্ষা শুধু আমাদের দেয়া নয়, ওদের বাবা-মা, পরিবারের ভেতর থেকে শিষ্টাচারের শিক্ষা পেয়েছে ওরা। আমার সকল শিক্ষার্থীই আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয় তবে ৭৩ ও ৮৪ ব্যাচের সাথে সম্পর্কটা যেন খানিকটা বেশিই। এরা কখনও আমার সাথ ছাড়ে না। ল্যাব-৮৪ এর বন্ডিং এতটাই বেশি- যা সত্যিই বিরল। এরা প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে, আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি সেও এই ব্যাচের ছাত্র। এদের সবাইকে যে মানুষটি এক সূতোয় বেঁধে রেখেছে সে হচ্ছে-অঞ্জন।   

জিক স্যার বলেন, বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়ে আত্ম-জীবনীমুলক বই লেখা সত্যি বেশ কঠিন ! সে কারণে আমার বইতে সাহিত্য রস কিছুটা কমই আছে। শ্রেণীকক্ষের ভেতরে কি হয়েছে সেগুলো আমার লেখায় খুব একটা স্থান পায়নি বরং শ্রেণীকক্ষের বাইরের ঘটনাগুলোকেই আমি লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। পেশাগত জীবনে আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে যুক্ত ছিলাম, বইটি পড়লে সে সম্পর্কে জানতে পাঠকরা জানতে পারবেন। গবঃ ল্যাবরেটরি স্কুলের অনেক অজানা তথ্যও জানা যাবে।



জিক স্যার বলেন, আমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল বিজ্ঞান। গভ: ল্যবরেটরিতে প্রথমবারের মত বিজ্ঞান ক্লাব করার পর ছাত্রদের আগ্রহ এতটাই বেড়েছিল যে শেষ পর্যন্ত দুইটা বিজ্ঞান ক্লাব প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল। তৎকালীন প্রধান শিক্ষক স্যার আমাকে একদিন তাঁর অফিসে ডেকে পাঠালেন, বললেন তোমার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে। অভিযোগ আছে বললেও তাঁর ঠোঁটে ছিল হালকা হাসির রেখা। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ছেলেরা নাকি ক্লাশের পড়া বাদ দিয়ে বিজ্ঞান নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকছে। আমি বললাম, স্যার তাহলে আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।

জিক স্যার বলেন, অবসর গ্রহণের পর যেখানেই গেছি বিজ্ঞান ক্লাব করেছি। মহান আল্লাহর কাছে আমার চাওয়ার আর কিছু নেই। শিক্ষক হিসেবে আমার কোন অপূর্ণতা নেই। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আমার জন্য যা কিছু করে তা বলে বোঝানো যাবেনা। কথাগুলো আমি সবাইকে জানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ছাত্ররা আমাকে এ বিষয়ে বলতে বারণ করে দিয়েছে, তাই বলতে পারছিনা। বই লেখার অনুপ্রেরণা, প্রকাশনা, মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানই শুধু নয় তাঁরা আমার সবকিছু বিষয়ে খোঁজখবর রাখে। আমার অসুখ-বিসুখে পাশে এসে দাঁড়ায়। সাধারন মানুষ যেখানে ডাক্তারের অ্যাপোয়েন্টমেন্ট পায়না সেখানে আমি কেন চেকআপে যাচ্ছিনা সেজন্য ডাক্তার ছাত্ররা আমাকে ফোন করে অভিমান দেখায়। তাহলে বলুন আমার জীবনে আর চাওয়ার কি আছে?