এক সময়ের খরস্রোতা ধলেশ্বরী নদী এখন সবুজে সমারোহ

কে এস রহমান শফি, টাঙ্গাইল:‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে, পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি, দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি, চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নেই কাদা, এক ধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।’ এ কবিতাটি কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি নদীর প্রাকৃতিক রূপ তুলে ধরেছেন। তুলে ধরা হয়েছে নদীর বৈশিষ্ট্য। তবে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ধলেশ্বরী নদীতে কবিতার ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে কোন মিল নেই। সাধারণ মানুষ এই নদী দেখে বুঝতেই পারবে না এটা নদী।

বন্যার সময় তলিয়ে যাওয়া ধলেশ্বরী নদীর বুকে আবাদ করা হয়েছে বোরো ধান ও সবজি। এক সময়ের খরস্রোতা ধলেশ্বরী নদী এখন সবুজে সমারোহ। গত ১২-১৩ বছর আগে থেকে এ নদীর বেশির ভাগ অংশে বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করে থাকে কৃষক। এ নদীর বুকে বন্যার মৌসুম ছাড়া বাকি সময় বিভিন্ন ফসল চাষ হয়ে থাকে। সদর উপজেলার কাকুয়া, কাতুলী, হুগড়া, মাহমুদনগর, বাঘিল, পোড়াবাড়ি, ছিলিমপুর ইউনিয়নের প্রায় ২০ কিলোমিটার নদীতে ধানসহ ফসল হচ্ছে।

পরিবেশ বাদী সংগঠন বেলার উর্ধত্বন গবেষনা কর্মকর্তা গৌতম চন্দ্র চন্দ জানান, টাঙ্গাইলের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যমুনা নদী থেকে ধলেশ্বরী নদীর সৃষ্টি হয়েছে। নদীটির দুটি শাখা রয়েছে। একটি শাখা পাশ্ববর্তী জেলা মাকিগঞ্জের উত্তর দিয়ে প্রবাহিক হয়ে মানিকগঞ্জের দক্ষিণে গিয়ে শেষ হয়েছে। অপরটি কালীগঙ্গার সাথে মিলিত হয়েছে। বুড়িগঙ্গা এক সময় ধলেশ্বরীর শাখা ছিলো। এর প্রবাহ পূনরায় ধলেশ্বরীতেই পতিত হয়।
সরেজমিন ধলেশ্বরী নদীর সদর উপজেলার চারবাড়ি, চর পাকুল্লা, কান পাকুল্লা, ঝিনাই পাড়া, তোরাপগঞ্জসহ বিভিন্ন অংশে গিয়ে দেখা যায়, যত দূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। নদীটির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে কৃষকের চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। নদীর উপরের সেতু ছাড়া বোঝার কোন উপায় নেই এটা কি নদী না অন্য কিছু। বোরো ধানসহ সবজি চাষ করছে কৃষকেরা। আবার অনেকেই গরু ছাগলও চড়াচ্ছে এই নদীতে। নদীতে বালুর পরিবর্তে রয়েছে উর্বর মাটি। যা কৃষকদের ফসল চাষে সহযোগি হচ্ছে।

চর পাকুল্লা গ্রামের ফরিদা বেগম (৫০) বলেন, ‘৩৫ বছর আগে আমার এই গ্রামে বিয়ে হয়েছে। ওই সময়ে নদী আমাদের বাড়ি থেকে কয়েকশ মিটার দূরে ছিলো। ওই সময়ে নদী অনেক গভীর থাকতো। চৈত্র মাসেও নদী দিয়ে নৌকা চইলা যাইতো। এখন নদী মরে গেছে। অন্য অঞ্চলের মানুষ এখানে আসলে বুঝতেই পারবে না এটা নদী। আগে এই নদী দিয়ে বড় বড় লঞ্চ, স্টিমার চলাচল করতো। এখন আর সেগুলি দেখা যায় না। ’

ওই গ্রামের মনতাজ আলী বলেন, ‘এ নদী দিয়ে নৌকা, স্টিমার ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলতো। এখন আর আগের মতো পানি থাকেও না। বন্যার সময় তিন থেকে চার মাস নদীতে পানি থাকে। বছরের বাকি সময়টা শুকনো থাকে। জমিটি নদীতে পড়লেও আমার বাবার নামে রেকর্ড করা দেড় বিঘা জমিতে ধানের চাষ করেছি। নদীর পাড়ে আগে কাশফুল ফুটতো এখন আর ফোটে না।’

৮৫ বছরের বৃদ্ধা রেজিয়া বলেন, ‘৭০ বছর আগে এই গ্রামে আমার বিয়ে হয়েছে। ওই সময়ের নদী আর বর্তমান সময়ের নদী আকাশ পাতাল পার্থক্য। তখন নদী দেখে নদীই মনে হতো। এখন নদী দেখে খালও মনে হয় না। কারণ নদীর পাড় নাই, গভীরতা নাই, নদীতে বালু নাই। যে কারণে আমরা ধানসহ সবজি চাষ করে থাকি। এ বছরও আমি এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি। এ ছাড়াও আগে এ নদী দিয়ে যমুনা সেতু দেখতে গেছি। এখন নৌকাযোগে যাওয়া খুব কষ্ট।

রহম আলী (৭৫) বলেন, ‘আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন চৈত্র বৈশাখ মাসেও নদীতে গোসল করেছি। সাঁতার কাটছি। আগে শুকনো মৌসুমে নদীতে কোথাও কোথাও বালু দেখা যেতো। এখন নদীর বুকে ধান আর সবজি চাষ করা হচ্ছে। গত ১২-১৩ বছর আগে থেকে চাষ করা হচ্ছে।
তোরাপগঞ্জ গ্রামের আরফান মিয়া (৬৫) বলেন, ‘ছোট বেলা দেখতাম চৈত্র মাসে এ নদীতে প্রচুর স্রোত থাকতো। পানি দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হতো। এখন নদী মরে গেছে। ধান, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করা হয়। ১২-১৩ বছর আগেও নদীতে অধিক বালু থাকার কারণে বাদাম ছাড়া অন্য কোন ফসল চাষ করা যেতো না।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. আমিন বলেন, ‘ধলেশ্বরী নদী বর্তমানে ফসলের মাঠে পরিণত হয়েছে। বালু পরিবর্তে উর্বর মাটিতে ভরে গেছে পুরো নদী। এ নদীতে ধানসহ যেকোন ফসল চাষ করলে ফলনও ভাল হয়।’

কাকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ওমরপুর, দেলদা, রাঙ্গাচিড়া ও চরপৌলি গ্রামের পাশ দিয়ে ধলেশ্বরী নদী বয়ে গেছে। আমার ইউনিয়নের ৫ কিলোমিটার নদীতে ধান, পাটসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করা হচ্ছে।’
বাঘিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম সোহাগ বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের লোহাজানি, গোপালপুর গ্রামের পাশ দিয়ে ধলেশ্বরী নদীর সীমানা প্রায় ৫ কিলোমিটার। প্রত্যেক জায়গাতে ধানসহ ফসল চাষ করা হচ্ছে।’

ছিলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদেক আলী বলেন, ‘পাকুল্লা, তেজপুর, সুবর্ণতলী গ্রামে পাশ দিয়ে ৪ কিলোমিটার নদী বয়ে গেছে। আগে নদীতে বালু আর বালু থাকতো। এখন উর্বর মাটি হওয়ায় ফসল চাষাবাদ করা হয়।’

পোড়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আজমত আলী বলেন, ‘খারজানা, বাউশা, নন্দিপাড়া, ঝিনাই গ্রামের পাশ দিয়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার নদীর সীমানা। এখন নদী নাই বললেই চলে। নদীর জায়গায় বন্যার সময় ব্যতিত বাকি সময় ফসল চাষ হচ্ছে।’

কাতুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ার‌্যান ইকবাল হোসেন বলেন, ‘ঘোষপাড়া, চকদই গ্রাম দিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার ধলেশ্বরী নদী বয়ে গেছে। প্রত্যেক জায়গাতেই ধান চাষ করা হচ্ছে।’

টাঙ্গাইলের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, ধলেশ্বরী নদীর টাঙ্গাইল সদর উপজেলা অংশে খনন করার পরিকল্পনা আছে। খননের মাধ্যমে এ নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হবে। ইতি মধ্যে নাগরপুর উপজেলার ৭ কিলোমিটার অংশে খনন করা হয়েছে।
======