আবুল বাশার মিরাজ, বাকৃবি:২০০২ সাল। সরকারি মেডিকেল কলেজে চান্স না পেয়ে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। তবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) চান্স পাই। তাও আবার ভেটেরিনারি অনুষদে। বন্ধুদের ঠাট্টার কথা শুনে কিছুটা ইতস্তত বোধ করছিলাম। ওরা আমাকে বলাবলি করতে লাগল গরুর ডাক্তার! গরুর ডাক্তার!
বাবা বললেন, বন্ধুদের কথা বাদ দাও! মানুষের সেবা করতে পারবে না তো কি হয়েছে? পশুপাখির সেবা করতে তো পারবে। আমাকে বোঝাতে লাগলেন-পশুপাখি স্রষ্টার সৃষ্টি অবলা প্রাণি, এদের চিকিৎসা করাও অনেক পূণ্যের কাজ। বাবার সে কথাগুলো আজ মনে পড়তেছে। আসলে মেডিকেলে পড়লে হয়ত এতদূর নাও আসতে পারতাম। দেশের বাইরে এসে হয়ত এতো ভালো গবেষণাও করতে পারতাম না। ঠিক এভাবেই বলছিলেন জাপানে অবস্থানরত বাংলাদেশী তরুণ বিজ্ঞানী ড. এম এ হান্নান।
সম্প্রতি তিনি জাপানের ইতিহাসে প্রথমবারের মত কৃত্রিম প্রজননের পর ভ্রুণ স্থান্তান্তরের মাধ্যমে ঘোড়ার বাচ্চা প্রসবে সফলতা পেয়েছেন। সারাবিশ্ব তার আবিষ্কারে আনন্দিত। তার সাথে কথা হয় এগ্রিলাইফের এ প্রতিবেদকের। শুনিয়েছেন গবেষণা জীবনের আদ্যপান্ত।
গবেষক জানান,‘আজকে আমার আবিষ্কার নিয়ে যা কিছু তার পিছনে ছিলেন আমার বাবা হাজী মরহুম নুরুল ইসলাম। তিনি আমাকে বাকৃবিতে ভর্তির পরামর্শ ও অণুপ্রেরণা না দিলে আমি এ পর্যন্ত আসতেই পারতাম না। আসলে আমি অনেক ভাগ্যবান ছিলাম, আমার বাড়ির (দিঘারকান্দা) পাশেই ছিল আমার ক্যাম্পাস। এমনকি আমি শৈশবে যে স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়েছিলাম তিনিই আমার আমেরিকায় সুপারভাইজার ছিলেন। এমনকি তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়েই আমার অনুষদের একই বিভাগে পড়াশোনা করছেন। আমার সেই স্যার (ড. আজিজ সিদ্দীকী)-এর পরামর্শেই আমি সবসময় চলার চেষ্টার করেছি। স্যার বর্তমানে আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। আমি সবসময় তার সাথে যোগাযোগ রাখতাম। তার পরামর্শেই বাকৃবির সার্জারি ও অবস্ট্রেট্রিক্স বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হই। কারণ স্যার জানতেন আমি নতুন নতুন আবিষ্কারের বিষয়ে বেশ আগ্রহী। আর একারণেই মাস্টার্সে আমাকে ওই বিভাগে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। মাস্টার্সে আমার সুপারভাইজার ছিলেন অধ্যাপক ড. মো. শামছুদ্দিন স্যার (বর্তমানে ইতালির রোমে এফএও এর হেড কোয়াটারে কর্মরত)। সত্যি কথা তার একান্ত সহযোগিতা না থাকলে গবেষণায় এত সুযোগ পেতাম না। আমি স্যারের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
এরপর বাকৃবি থেকে অনার্স শেষ করে ২০০৮ সালে মাস্টার্সে ভর্তি হলাম। আমাদের মাস্টার্স মূলত তিন সেমিস্টার (এর মধ্যে দুই সেমিস্টার একাডেমিক আর এক সেমিস্টার থিসিস)। আমি দুই সেমিস্টার একাডেমিক শেষ করে ড. আজিজ এবং ড. শামছুদ্দিন স্যারের সহযোগিতায় আমেরিকায় ইউনিভার্সিটি অফ উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রজেক্টে গবেষণা করার সুযোগ পাই। এ কারণে আমি মাস্টার্সের গবেষণার কাজে আমেরিকায় চলে যেতে হয়। আমার গবেষণার কাজ মূলত এখানেই সম্পন্ন হয়। গবেষণা শেষে বাংলাদেশে এসে গবেষণা পত্র (থিসিস) জমা দিয়ে আমার মাস্টার্স ডিগ্রী হয়। সেসময় ভালো গবেষণা করার কারণে গবেষণা সহযোগী হিসাবে আমি আবার আমিরিকাতে ডাক পাই। তখন আবার আমেরিকায় চলে যাই। ১ বছর পরে আমি ফিরে এসে ঢাকার মহাখালীস্থ কলেরা হাসপাতালে (আইসিডিডিআরবি) রিসার্চ অফিসার হিসাবে যোগদান করি।
গবেষণা নিয়ে আমার ছিল তীব্র নেশা। এ কারণে পরের বছরে ফের জাপান সরকারের মনবুকাগোসো বৃত্তি নিয়ে জাপানের ওসাকা প্রিফেকচার ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করার জন্য চলে যাই। এখান থেকে ২০১৭ সালে অত্যন্ত সফলতার সাথে পিইএচডি সম্পন্ন করে সাভারের গণ বিশ্বিবিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে শিক্ষকতায় যোগদান করি। একই বছর পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপের সুযোগ পেয়ে গণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা ছুটি নিয়ে জাপানের অবিহিরো ইউনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচার এন্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ইয়াসুও নামবোর তত্ত্বাবধানে ভ্রূণ স্থানান্তরের রিসার্চ প্রজেক্টে যোগদান করি। এখানেই শুরু হয় আমার ঘোড়া নিয়ে গবেষণার কাজ। সবসময় চেয়েছি নতুন এমন কিছু নিয়ে গবেষণা করব যা সারাবিশ্বে তাক লাগাবে। গত ১০ এপ্রিল এ প্রযুক্তি ব্যবহারে আমরা সফলতা পাই। যা ছিল জাপানের ইতিহাসে একেবারেই প্রথম।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে হান্নান বলেন, জাপানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হিমায়িত শুক্রাণু দ্বারা ঘুড়ীকে কৃত্রিম প্রজননের পর তা থেকে ভ্রূণ সংগ্রহ করে অন্য ঘুড়ীতে স্থানান্তর করি। যা সুস্থ বাছুর জন্ম দিয়েছে। ভ্রূণ সংগ্রহ ও স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় কোনো প্রকার অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়নি। এজন্য প্রথমে আমি ইউরোপ থেকে ‘আইরিশ কনেমারা পনি’ জাতের পুরুষ ঘোড়ার হিমায়িত সিমেন আমদানি করি। পরে এটি ‘জাপানীজ হোক্কাইডো পনি’ জাতের ঘুড়ীতে কৃত্রিম প্রজনন করাই। পদ্ধতিটি উভয় ভ্রূণ দাতা এবং গ্রহীতা ঘুড়ীর স্বাস্থ্যের জন্য সুম্পূর্ণ নিরাপদ। এ প্রক্রিয়ায় গত বছর (২০১৮) মে-জুন মাসে আমরা ১ টি দাতা ঘুড়ী থেকে ভ্রূণ নিয়ে ৩ টি গ্রহীতা ঘুড়ীকে গর্ভবতী করি, যাদের মধ্যে একটি এ বছর (১০ এপ্রিল) একটি সুস্থ নতুন সংকর জাতের বাছুর জন্ম দেয়। এ সুসংবাদ নিয়ে গত ১২ ই এপ্রিল জাপানের প্রধান দৈনিকগুলো অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে খবরটি প্রকাশ করে। পাশাপাশি, ঘুড়ীগুলোর গর্ভধারণের বিষয়টি চূড়ান্তভাবে (আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির দ্বারা) নিশ্চিত হয়ে সেই ফলাফল একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে (Hannan et al., 2019; Journal of Veterinary Medical Science) প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও আমার গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে ইতিমধ্যেই মোট ২৩ টি বৈজ্ঞানিক রিসার্চ আর্টিকেল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে এই গবেষক বলেন, যতদিন বেঁচে আছি ততদিন গবেষণা চালিয়ে যেতে চাই। এ বছরের শেষের দিকে আমার দেশে ফেরার পরিকল্পনা আছে। বাংলাদেশে এসে এ প্রযুক্তি প্রয়োগ করে দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় ঘোড়া পুনরুদ্ধারে কাজ করতে চাই। বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদে এখনও অনেক ঘাটতি আছে, বিশেষ করে কোরবানির সময় প্রচুর প্রাণী ও অনান্য সময়ে গরুর গুড়োদুধ আমদানী করতে হয়। সে কারণে দেশে ফিরে গরু ও মহিষে এ প্রযুক্তিটি প্রয়োগ করতে চাই। আর আমি গবেষণা করে দেখেছি ঘোড়ার চেয়ে গরুতে ভ্রূণ স্থানান্তর প্রযুক্তির প্রয়োগ সহজ এবং সফলতার হার অনেক বেশি। এজন্য আমি আমাদের দেশীয় জাতের অপেক্ষাকৃত ভালো মানের গাভীগুলোকে বিদেশী জাতের উচ্চগুণসম্পন্ন ষাঁড়ের বীজ দ্বারা কৃত্রিম প্রজনন করে নতুন উচ্চমানসম্পন্ন সংকর জাত উদ্ভাবন করতে চাই। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কয়েক বছরের মধ্যেই প্রচুর সংখ্যক উচ্চমানের দুধ ও মাংস উৎপাদনকারী গরু ও মহিষের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটিয়ে বাংলাদেশকে ডেইরি ও মাংস শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারবো।