আবুল বাশার মিরাজ, বাকৃবি:একুশ শতকের তথ্যপ্রযুক্তিগত বিপ্লব মানব সভ্যতার গতিপ্রকৃতি দ্রুত বদলে দিচ্ছে। বদলে যাচ্ছে জীবনযাপন পদ্ধতি এবং জীবনমান। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার নিয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। এত কিছুর পরও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ক্যাম্পাসে ইন্টারনেট সংযোগের হাহাকার আর বিড়ম্বনায় চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
ডিজিটাল এ যুগেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখনো মানসম্মত ইন্টারনেট সংযোগ পাচ্ছেন না। এতে শিক্ষার্থীরা তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরাজ করছে ক্ষোভ আর হতাশা। সম্প্রতি এ নিয়ে মুরাদ মোর্শেদ নামের এক শিক্ষার্থী ‘বাকৃবি ক্যাম্পাসে ব্রডব্যান্ড কানেশন চাই’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপও খুলেছেন। শতশত শিক্ষার্থী দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র ফাইবার ক্যাবল ও ওয়াইফাই সিস্টেম স্থাপনের কাজ শুরু হয় গত ২০১৩ সালের জুন মাসে। সে বছর ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র ওয়াইফাইয়ের আওতায় আনার কথা থাকলেও নানাবিধ কারণে তা পিছিয়ে পড়ে। ২০১৪ সালের মাঝামাঝিতে ওয়াইফাই সংযোগ পেয়ে আনন্দে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু প্রতিটি হলের জন্য মাত্র একটি রাউটার স্থাপন করায় হলের সবাই এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সেটা চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয় হল প্রভোস্টরা ছেলেদের ৯টি হলে মোট ১২টি অতিরিক্ত রাউটার সংযোগ করেন। কিন্তু এরপরও চাহিদামত ইন্টারনেট সংযোগ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন অনেক শিক্ষার্থী।
এছাড়াও ছাত্রীদের ৪টি হলে পরবর্তীতে নতুন কোন রাউটার না লাগানোই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন তারা। বেগম রোকেয়া হলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, হলে নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে মোবাইল কোম্পনির ইন্টারনেট ক্রয় করেও তা ব্যবহার করতে পারছি না।
২০১৩ সালে ৩৮ এমবিপিএস ব্রান্ডউইথ দিয়ে যাত্রা শরু করলেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যান্ডউইথের পরিমাণ ৩০১এমবিপিএস। সরকারি (বিটিসিএল) ব্যান্ডউইথের পরিবর্তে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনিক কম্পিউটারের কাছ থেকে ব্যান্ডউইথ কেনা হচ্ছে। প্রতি এমবিপিএসের জন্য বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে গুনতে হচ্ছে ৬৫০টাকা। আর এ সমপরিমাণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যান্ডউইথ দিয়ে ৭০০৮টি সংযোগ ইন্টারনেট দেওয়া হয়েছে। আর এ সংযোগ দেওয়ার জন্য আইসিটি সেলে নিয়োজিত রয়েছেন একজন স্যারের তত্ত্বাবধানে মাত্র ৬জন টেকনিশিয়ান। এদের মধ্যে ৫ জনই সাময়িক বেতনভুক্ত (মাস্টাররোল) কর্মচারী হিসেবে নিয়োজিত। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩টি হল, অফিস, আবাসিক শিক্ষককের বাসায় সংযোগ ও মেরামতের কাজ তদারকি করে থাকেন। জনবল কম হওয়ায় তারা সার্বক্ষণিক সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে ওয়াইফাই সংযোগ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রতিটি স্নাতক শিক্ষার্থীর জন্য সেমিস্টার প্রতি ১২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এমনকি কেউ যদি ওয়াইফাই নাও ব্যবহার করতে পারে, তাকেও গুনতে হবে সমপরিমাণ অর্থ।
সরজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হলগুলোর বেশির ভাগ কক্ষেই ওয়াইফাই পাওয়া যায় না। এদের মধ্যে শামসুল হক হল, ফজলুল হক হল, বঙ্গবন্ধু হলে সমস্যাটি বেশ জোরালো। ওয়াইফাই রাউটারের মাত্র কয়েক গজের মধ্যে থেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এর ফলে শিক্ষার্থীদের রাউটারের নিচে ভিড় করতে দেখা যায়। রাউটারের নিচে গিয়েও ওয়াইফাইয়ের কচ্ছপগতির কারণে ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করেছেন অনেক শিক্ষার্থী। এমনকি মাঝে-মধ্যেই বিনা কারণে ওয়াইফাই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর একবার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে দুই-তিন দিন লেগে যায় তা ঠিক করতে।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম গতিশীল করার লক্ষ্যে চালুকৃত ওয়াইফাই সংযোগের ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীরা শিকার হচ্ছেন ভোগান্তির। প্রয়োজনের সময় এ সুবিধা না পেয়ে এবং ভোগান্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেক শিক্ষার্থী বাধ্য হয়েই ঝুঁকছেন বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির দিকে। এ জন্য শিক্ষার্থীদের গুনতে হচ্ছে প্রচুর নগদ অর্থ।
তামবীর আহমেদ নামের এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, ক্যাম্পাসে পূর্বের চেয়ে এখন অনেক বেশি রাউটার আছে। কিন্তু তাতে কি? সমস্যা আগের মতই আছে, কিছু কিছু সময় তো আগের থেকেও ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। এখনকার নতুন সমস্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, কানেকশন এই আছে, এই নেই। কোন একটা কাজ করতে যেয়ে যদি মধ্যখানে নেটওর্য়াক কানেকশন চলে যায় তবে বুঝুন সম্পূর্ণ কাজটুকুই নতুন করে করতে হয়। তাতে তাড়াতাড়ি কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও কখনই সম্ভব না।
নজরুল ইসলাম বলেন, অনেক দেরিতে হলেও আমরা ওয়াইফাই এর আওতায় এসেছিলাম কিন্তু সমস্যা হলো সময়ের সাথে মানুষ যখন উন্নত নেটওয়ার্কের আওতায় আসছে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। যতদূর জানি গুগলে কোন কিছুতে সার্চ করতে কিলোবাইট হারে ডাটা লাগে তবে আমাদের এই ওয়াইফের সুবিধা এতই উন্নতমানের যে গুগল সার্চ অনশনে ক্লিক করে তীর্থের কাকের মত ১০ থেকে ২০ মিনিট চেয়ে থাকতে হয়। আর এ সমস্যায় সবচেয়ে ভুক্তভোগী এসাইনমেন্ট কিংবা প্রেজেন্টেশান স্লাইড তৈরী করার সময়। দুঃখজনক যে আমাদের স্যাররা এটি উপলব্ধি করতে পারেন না। কেননা উনারা উন্নতমানের সেবার আওতায়।
নাহিদ হাসান শোভন বলেন, বাকৃবির ওয়াইফাই এতটাই জঘন্য যে অন্য ক্যাম্পাসের বন্ধুরা আসলে তাদের সামনে লজ্জিত হতে হয়। ব্রডব্যান্ড নাই, ওয়াইফাইয়ের বেহালদশা! শুধু ফেসবুকই চলে। তাও অনেক সময় স্পিড পুরোই জিরো হয়ে যায়। বার বার কানেকশন চলে যায়। অথচ গুরুত্বপূর্ণ কাজ, পড়ালেখা বিষয়ক কিছু জানতে ইউটিউবে গেলেও বাফারিং চলতেই থাকে, ভিডিও আর চালু হয় না। আর যারা অনলাইনে কাজ করে, আউটসোর্সিং, ইউটিউবিং তারা তো মাইর খেয়ে যাচ্ছে বাকৃবিতে এসে। গুরুত্বপূর্ন সময়ে উচ্চমূল্যের ডাটা কিনে নেট ব্রাউজ করতে হয়।
ব্রডব্যান্ড সংযোগের দাবি: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অফিসারদের চেম্বার ও আবাসিক বাসভবনে তার যুক্ত ব্রন্ডব্যান্ড সংযোগ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এ সেবা পান না শিক্ষার্থীরা। অনান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় শিক্ষার্থীরা টাকা দিয়ে হলেও ব্রডব্যান্ড দিতে আগ্রহী। মেহেদী হাসান রাতুল নামের এক শিক্ষার্থীরা বলেন, ব্রডব্যান্ড না থাকার কারণে অ্যাসাইনমেন্ট করতে সমস্যা হচ্ছে। এমএ- এর রির্সাচের জন্য যে বিভিন্ন সময় রিসার্চ পেপার তৈরির কাজে সমস্যা হচ্ছে। বিভিন্ন সময় ইমেইল করতে গেলেও বারান্দায় ল্যাপটপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ধীর গতির জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা সময় নষ্ট হয়। অবসর সময়ে যে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় এর ওয়েবসাইট খোঁজ করব সেটিও সম্ভব হচ্ছে না।