অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান:বিশ্ব আল-কুদস দিবস উদযাপন উপলক্ষে মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস পূনরুদ্ধার ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করে আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে গত শুক্রবার ৮ জুন, ২০১৮ ইং ২২ রমজান, ১৪৩৯ হি. বিকাল ৩.৩০ টায় ঢাকার প্রেসক্লাবের বিপরীতে বিএমএ মিলনায়তনে ‘আল-কুদস ও ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাঈলী দখলদারিত্বের ৭০ বছর: মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনার ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশের সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ কাওছার মুস্তাফা আবুল ওলায়ীর সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-১ আসনে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য এডভোকেট লুৎফুল্লাহ এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনভী এবং সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটির ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মিশকাত উদ্দীন।

আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক, বিশিষ্ট কলামলেখক, গবেষক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে টক শো’র আলোচক/উপস্থাপক ও বহির্বিশ্ব কার্যক্রম বাংলাদেশ বেতারের সংবাদ পাঠক এবং এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খানের সঞ্চালনায় সেমিনারে স্বাগত ভাষণ দেন আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশের সহ-সভাপতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবি এ.কে.এম. বদরুদ্দোজা।

পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করেন ক্বারী সাইয়েদ মুহাম্মদ রেজা রাজাভি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান’ শীর্ষক ঈমানী চেতনা জাগানিয়া ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন করেন রেডিও তেহরানের  সংবাদ পাঠক, কবি ছড়াকার ও মর্সিয়া লেখক জনাব শাহনেওয়াজ তাবিব।

সেমিনারে ‘আল-কুদস ও ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাঈলী দখলদারিত্বের ৭০ বছর: মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক আজকের ভোলা পত্রিকার সম্পাদক অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শওকাত হোসেন। প্রবন্ধের উপর আলোচনায় অংশ নেন মাসিক মদীনা পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা আহমদ বদরুদ্দীন খান ও বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়েদ আফতাব হোসেন নাকাভি।

উল্লেখ্য যে, ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর অবিসংবাদিত আধ্যাত্মিক মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (র.) মুসলমানদের প্রথম কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস ইহুদীবাদী ইসরাঈলের জবরদখল থেকে পূনরুদ্ধার ও ফিলিস্তিনের মুসলিম গণমানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সংহতি ও অকুন্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করে মুসলিম উম্মাহর মাঝে গণসচেতনতা জাগ্রত করার লক্ষ্যে মাহে রমজানের চতুর্থ শুক্রবারকে ‘বিশ্ব আল-কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে দিবসটি একযোগে পালনের জন্যে সব দেশের মুসলমানদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। সেই থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বরেণ্য শিক্ষাবিদ, বহু পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও আল-কুদ্স কমিটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক আ.ন.ম. আবদুল মান্নান খান (১৯৪৩-২০০৯ খ্রি.)-এর সভাপতিত্বে বাংলাদেশেও ‘আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে প্রতিবছর মাহে রমজানের শেষ শুক্রবার আরববিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক সেমিনার, আলোচনা সভা, টকশো, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়ে আসছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশেও পালিত হচ্ছে।

বিশ্ব আল-কুদস দিবস উদযাপন উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশ কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথির ভাষণে জাতীয় সংসদ সদস্য এডভোকেট লুৎফুল্লাহ এমপি ফিলিস্তিনী সংগ্রামীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও লাল সালাম জানিয়ে বলেন, ‘যেখানেই জুলুম-নির্যাতন, যেখানেই সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র থাবা, যেখানেই মানবতার পতন সেখানেই আমরা আছি এবং আমরা থাকবো। আজকে সারাজ্যবাদী আমেরিকা আরব মুসলমান ও গণমানুষের উপর জুলুম করছে। মানবিক ঐক্যের মাঝে ফাটল ধরিয়ে আরব ও মুসলিম সমাজকে বিভক্ত করে শোষণের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। সেজন্যেই তারা ইসরাইল নামের কঠিন অপশক্তির বীজ বপন করেছে। ইহুদী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা যারা লালন করেন দল-মত নির্বিশেষে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতাম তবে ইহুদী মার্কিন পুঁজীবাদী সাম্রাজ্যবাদীরা দুনিয়ার কোথাও বিপর্যয় ঘটাতে পারতো না। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হই তবেই আমাদের ভুখন্ড, আমাদের অধিকার, আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, আমাদের যা কিছু আছে সবই আমরা পূনরুদ্ধার করতে পারবো।’

বিশ্ব আল-কুদস দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকায় নিযুক্ত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনবী বলেন, ‘৭০ বছর আগে একটি শয়তানী রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যায়নবাদী ইসরাইলের স্বপ্ন ছিলো নীলনদ থেকে ফোরাত পর্যন্ত বিস্তৃত এক ইহুদী রাজত্ব কায়েম করা। কিন্তু প্রকৃত মুসলমানদের আত্মজাগৃতির ফলে হামাস ও হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ সংগ্রামের ফলেই সেটা সম্ভব হয়নি। ফিলিস্তিনের মানুষ বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত। রাষ্ট্রদূত পবিত্র কোরআন থেকে উদ্ধৃতি পেশ করে বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘কি হয়েছে তোমাদের কেনো তোমরা সংগ্রাম করবেনা আল্লাহর পথে ঐ সকল নির্যাতিত নারী পুরুষ ও শিশুদের জন্যে যারা ফরিয়াদ করছে হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে উদ্ধার করো জালেমের সাম্রাজ্য থেকে। দাও সাহায্যকারী, দাও রক্ষাকারী।’ আর রাসূলুল্লাহ (সা) হাদীসে বলেছেন,  ‘কোন মুসলমানের সমস্যা যদি অন্য মুসলমানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে না হয় তবে সে মুমিনই নয়।’ আজকে ফিলিস্তিনের জনগণের চেয়ে আর কে বেশি নির্যাতিত হতে পারে?

ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনবী আরো বলেন, ইসরাইল রাষ্ট্রটি মুসলিম বিশ্বে একটি ক্যান্সার সদৃশ। এর বিস্তৃৃতি ঘটেছে সাম্রাজ্যবাদীদের সহায়তায় যায়নবাদী ইহুদীদের দ্বারা। এ সমস্যা শুধু ফিলিস্তিনীদের সমস্যা নয়, গোটা মুসলমানদের সমস্যা। কেবল মুসলমানদেরই নয়, সমগ্র বিশ্ব মানবতার সমস্যা এটি। এখানে মুসলিম গণমানুষের উপর অমানবিক নির্যাতন হচ্ছে। কাজেই এটি কেবল ইসলামী ইস্যুই নয়, মানবিক ইস্যুও বটে। খ্রিষ্ট সমাজের অনেক মানবতাবাদীও এর প্রতিবাদ করছে। এমনকি নির্দোষ কিছু ইহুদীও যায়নবাদীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।  সেখানে নিষ্পাপ শিশু, অসহায় নারী, যুবক, বৃদ্ধকে নির্বিচারে নরহত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু তাওরাতে বা ইঞ্জিলে তো কোথাও নেই নির্দোষ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করতে হবে। এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা ও বিশ্বব্যাপী গণজোয়ার সৃষ্টির জন্যই ইমাম খোমেইনী (র.) মাহে রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘বিশ্ব আল-কুদস’ দিবস ঘোষণা করেন। অনেক দেশ এটাকে স্বাগত জানায়। অনেক দেশের সরকার স্বাগত না জানালেও জনগণ এর সাথে একাত্ম হয়েছে। আবার অনেক মুসলিম দেশের শাসক কুদস দিবসের চেতনার সাথে একাত্ম না হয়ে আমেরিকা ও ইসরাইলকে সহযোগিতা করছে।

তিনি বলেন, সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের সহযোগী এসব শাসকেরা শিয়া-সুন্নি ইসু্যু তুলে মুসলিম বিশ্বকে বিভক্ত করেছে ও করছে। তারা আইএস, আল-কায়েদা ও তালেবান নামের সন্ত্রাসী তৈরী করে মুসলমানদের দিয়ে মুসলমানদের ধ্বংস করছে। এই বিভক্তির ফলে ইহুদীবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরই লাভবান হচ্ছে। আপনারা জানেন ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর ইমাম খোমেইনী (র.) শিয়া-সুন্নি সহ মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের জন্যে নানাভাবে আহবান জানিয়েছেন। আমরা ইরানীরা জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে সেসব চেষ্টা করে গেছি। অনেক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম  করেছি। আমরা যদি প্রকৃত অর্থেই মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক  কোরআনের পথে আসতাম তবে আমাদের মধ্যে এই হানাহানি বা বিভক্তি থাকতো না। মাহে রমজান হচ্ছে কোরআন নাজিলের মাস। আমাদেরকে কোরআনের পথে আসতে হবে। এ মাসে আমাদের রোজা, নামাজ, তারাবীহ, কিয়ামুল লাইল, তাসবীহ-তাহলীল, জিকির-আজকার ইত্যাদি সব ইবাদতের মাধ্যমে  আত্মিক শক্তি অর্জন করতে হবে। আর নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তবেই বাতিল, শয়তান ও শয়তানী শক্তি পরাজিত হবে ইনশাআল্লাহ।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটির ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মিশকাত উদ্দীন প্রবন্ধকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘প্রবন্ধকার অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফিলিস্তিন সমস্যর তাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো তুলে ধরে মুসলমানদের সফলতা, ব্যর্থতা ও করণীয় সম্পর্কে বিষদ আলোচনা করেছেন।

৭০ বছরের অধিক সময় ধরে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উপর যে অকথ্য অত্যাচার চলছে একমাত্র মানবিক ঐক্যের জোয়ার দ্বারাই একে প্রতিহত করা সম্ভব। মুসলিম হোক, অমুসলিম হোক কোন মানুষের প্রতিই কোন প্রকার নির্যাতন মেনে নেওয়া যায় না। ইসরাইলের প্রধান মদদদাতা হচ্ছে আমেরিকা। এরপর রয়েছে বৃটেন ও ফ্রান্স। শুধু ফিলিস্তিনেই নয়; মিয়ামনারে, ইয়ামেনে, ইরাকে, আফগানিস্তানে, কাশ্মিবে, চেচনিয়ায়. সিরিয়ায় সবখানেই মুসলমানরা নান বিপর্যয়ের সম্মুখীন। একসময় বসনিয়ায় নির্যাতন হয়ে্েরছ। বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে ভারতের শিব সেনারা। এখনো সে দেশে মুসলিম নির্যাতন হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমাদেরকে দাঁড়াতে হলে ইসলামী ঐক্যের সাথে সাথে প্রকৃত সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হবে। আমাদের নিজেদেরকে বৈজ্ঞানিক ও সামরিক শক্তিতে যেমন বলিয়ান হয়ে তাদেরকে প্রতিহত করতে হবে এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও প্রতিহত করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। ’

প্রবন্ধের উপর আলোচনায় মাসিক মদীনা পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা আহমদ বদরুদ্দীন খান মিসরের জাতীয় কবি আহমাদ শাওকীর কবিতার একটি লাইন উচ্চারণ করে এর অর্থ করে বলেন যে, ‘আল-কুদস মুসলমানের কেবল রাষ্ট্রীয় সম্পদই শুধু নয় আল-কুদস হচ্ছে মুসলমানদের ঈমানের স্তম্ভ। মুসলমানদের ঈমান এবং অস্তিত্বের জন্য মক্কা, মদীনা এবং আল-কুদস অবিনাশী অংশ রূপে অপরিহার্য। এর কোন একটি মুসলমানের হাতছাড়া হয়ে গেলে মুসলমানদের বিপর্যয়ের সীমা থাকবে না। এটি এক সময় ইহুদীদের নিয়ন্ত্রণেই ছিলো। কিন্তু এরা এক অভিশপ্ত জাতি রূপে আল-কুদসের অধিকার হারিয়েছে। ‘আল-কুদস’ মুসলমানেরকে দিয়েই আল্লাহ তাআলা তাদের মর্যাদাকে বর্ধিত করেছেন। ইহুদীরা হচ্ছে সেই অভিশপ্ত জাতি যারা তাদের নবীদেরকে হত্যা করেছে। যারা আল্লাহকে গালি দেয়। আর যারা তাদের ধর্মগ্রন্থকে বিকৃত করেছে। আজ কোনটা যে তাদের আসল ‘তাওরাত’ তা বুঝা দায়। তারা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পৃথিবীতে বড় বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এসব কথা কোরআনেও রয়েছে। হিটলার ইহুদীদেরকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলো। খলিফা হযরত ওমর (রা.)-এর হাতে জেরুজালেমের চাবি হস্তান্তরের পর থেকে তা যখন মুসলমানদের হাতে আসে সেই অবধি ইহুদীরা পূনর্বার  সেটা পাওয়ার জন্য যুগ যুগ ধরে নানা চেষ্টা তদবির ও ফন্দি-ফিকির চালিয়ে আসছিলো। নুরুদ্দিন জঙ্গী, তুরকী সম্রাট হামিদ এবং সালাউদ্দিন আইয়ুবীকে অনেক প্রলোভন দেখিয়েও তারা সেটি তাদের দখলে নিতে পারেনি বা এর আশেপাশে বসতি স্থাপন করতে পারেনি। তাই তারা এখন আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স-এর সহযোগিতা প্রাপ্তির সাথে সাথে মুসলিম বিশ্বের কিছু ভোগবাদীর রাজা-বাদশাদেরকেও হাত করে ফেলেছে। এই গণবিচ্ছিন্ন রাজা-বাদশাহরা তাদের ক্ষমতার স্বার্থে ইহুদীদের সাথে হাত মিলিয়েছে। কিন্তু তারা জানে না যে, ইহুদীরা এসব নামধারী মুসলমানরা যদি নিজেদেরকে ইহুদীতে পরিণতও করে তবু তারা ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচতে পারবে না।

প্রবন্ধের উপর আলোচনায় হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ আফতাব নাকাবী বলেন, ‘রমজান মাসের ২১ তারিখে হযরত আলী (রা.) শাহাদাত বরণ করেছিলেন, যিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আহলে বাইত এবং তাঁর প্রজ্ঞাবান সহচর এবং অলি মহাপুরুষ। এই মহাপুরুষকে হত্যার পর ৭০ বছর উমাইয়া শাসকদের প্ররোচনায় বিভিন্ন মসজিদে তাঁর বদনাম করে গালাগালি করা হতো। কিন্তু ৭০ বছর পর মুসলমানের ভুল ভাঙে। খলিফা ওমর বিন আবদুল আযিজ সেই সব গালাগালি বন্ধ করে দেন। কাজেই ৭০ বছর যাবৎ ফিলিস্তিনীরা নির্যাতিত হলেও ইনশাআল্লাহ এসব নির্যাতনের দিন অচিরেই শেষ হয়ে যাবে।

জনাব নাকাবী বলেন, সারা দুনিয়ায় একটি নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। ইমাম খোমেইনী (র.)-এর নেতৃত্বে আল-কুদসের ঘোষণার পর সেটি বিশ্বের মুসলমানরা গ্রহণ করেছে। এখন আমাদের শুধু দরকার কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার। মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রতিবন্ধক সকল বিষয় দূরীভূত করতে হবে। মুসলমানদের মাঝে সঠিক দ্বীনী চেতনা যা আহলে বাইতের মাঝে ছিল সেটার প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে। শিয়া ও সুন্নি মাজহাবের ভেতর সমন্নয় ঘটাতে হবে। তরুণদেরকে সজাগ করতে হবে ও তাদেরকে দ্বীনী বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে যাতে অপসংস্কৃতি তাদেরকে গ্রাস করতে না পারে। তাদেরকে মুসলমানদের প্রকৃত ইতিহাস শেখাতে হবে ও তাদের ভৌগলিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতি ঐতিহ্যের পরিচয় তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। ফিলিস্তিন, মিয়ামনার সহ পৃথিবীর যে কোন জায়গায় মুসলমান নির্যাতিত হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে ও তাদের প্রতি অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে বূলন্দ করতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. শাহ কাওছার মুস্তাফা আবুল ওলায়ী বলেন, ‘ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসকে পূনরুদ্ধারের জন্য পবিত্র জুমাতুল বিদাকে আল-কুদস দিবস ঘোষণা করে দল-মত, মাজহাব-তরিকা নির্বিশেষে সকল মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সেই প্রচেষ্টা তার আহবানে সারা দেওয়া মুসলমানেরা এখনো অব্যাহত রেখেছে। আজকে প্রতিবছর মাহে রমজানের শেষ শুক্রবার সারা বিশ্বে দিবসটি একযোগে পালিত হচ্ছে। কিন্তু মুসলিম ঐক্য বিনষ্টকারীরা শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ তৈরীর জন্য চালাচ্ছে ভয়ানক ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টা। মুসলমানদেরকে যে কোন মূল্যে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যের কোন বিকল্প নাই। ফিলিস্তিন সহ যে কোন দেশের মুসলমানরা আমাদের ভাই-বোন। তাদের উপর নির্মম নির্যাতন হচ্ছে অথচ ফিলিস্তিনের পাশেরই কোন কোন দেশ ইসরাইলের সাথে সখ্যতা স্থাপন করে চলেছে। ন্যূনতম ঈমান থাকলেও তো কোন মুসলমান এটা করতে পারে না।

তিনি আরো বলেন, ‘বিশ্ব আল-কুদস দিবস পালনের মধ্যে দিয়ে আল-কুদস মুক্তির বিপ্লবী আওয়াজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা প্রতিবছর দিবসটি পালন করছি। এর নেপথ্যে রয়েছে অনেক নিবেদিতপ্রাণ মানুষের অবদান। সভাপতি সেমিনারে উপস্থিত সুধীবৃন্দকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আপনারা যারা ত্যাগ স্বীকার করে এখানে সময় ব্যয় করেছেন এজন্য আল্লাহ পাক আপনাদেরকে উত্তম পুরস্কার দান করবেন।

স্বাগত ভাষণে আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশের সহ-সভাপতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবি এ.কে.এম. বদরুদ্দোজা বলেন, ‘ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনী গণহত্যা যেনো আজ সেখানকার জনগণের নিয়তি হয়ে দাড়িয়েছে। প্রতিদিন সেখানে কোন না কোন স্থানে মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে। বিশ্বের নানা স্থানে মুসলমানদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। ইমাম খোমেইনী (র.) কর্তৃক আল-কুদস দিবসের যুগান্তকারী ঘোষণা বিশ্বে সত্যিকার অর্থেই একটা প্রভাব ফেলেছে। যত নির্যাতনই চালাক না কেনো ইহুদী যায়নবাদী ইসরাইল নৈতিকভাবে পরাজিতই হচ্ছে। এর বাস্তব প্রমাণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ফুটবল দলের বিশ্ব সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি কর্তৃক ইসরাইলের সাথে প্রীতি ফুটবল ম্যাচকে বয়কট করে দেওয়া। শুধু মুসলমানই নয়, ফিলিস্তিনি মানবতার উপর ইসরাইলী বর্বরতা সকল মানবতাবাদী মানুষেরই ঘৃণা কুড়িয়েছে।

আর ইমাম খোমেইনী (র.) এর ঘোষিত আল-কুদস দিবস সারা বিশ্বে সত্যিকার অর্থেই একটা জাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। তাই নেতানিয়াহুর টেলিফোনে অনুরোধ সত্ত্বেও আজেন্টিনার দলনেতা লিওনেল মেসি সহ পুরো দলের মন গলানো যায়নি আর্জেন্টিনা ইসরাইল চ্যারিটি ম্যাচে। কারণ এর ভেতর এক ইসরাইলি রাজনৈতিক প্রতারণা লুকয়িত ছিলো তা তারা বুঝতে পেরেছে। আমরা ধন্যবাদ জানাই মেসি সহ সমগ্র আজেন্টিনা বিশ্বকাপ দলকে।

তিনি বলেন, ‘আজকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড  ট্রাম্পের প্রচেষ্টায় জেরুজালেমে ইসরাইলের রাজধানী স্থাপনের চেষ্টায় একটা ধাক্কা খেয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেউ জেরুজালেমে তাদের দূতাবাস স্থানান্তর করেনি। পৃথিবীর মানবতাবাদীরা বিবেকের বিচারের ডাকে সারা দিয়েছে। সেটি এই আল-কুদসের চেতনা সম্প্রসারণেরই ফল।’

সেমিনারের আগে জুমার নামাজের পর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আল-কুদস দিবস উপলক্ষে মানবতার দুশমন ইহুদীবাদী ইসরাইলী বর্বরতার প্রতিবাদ ও ফিলিস্তিনী জনতার সংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এক মানব বন্ধন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন দৈনিক আজকের ভোলা সম্পাদক অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শওকত হোসাইন। মানব বন্ধনে বক্তৃতা দেন আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশের সেক্রেটারী  জেনারেল মোস্তফা তারেকুল হাসান, মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন, আবু বককর সিদ্দিক, কবি আমিন আল-আসাদ ও মাওলানা মুহিবুল্লাহ প্রমুখ। এছাড়া মানব বন্ধনে আরো উপস্থিত ছিলেন হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়েদ আফতাব নাকাভী, সাংবাদিক আহমদ আতিক, ক্বারী আলমগীর হোসেন মোল্লা, কবি ছড়াকার মহিউদ্দিন আকবর, নিউজ লেটার পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ড. জহির উদ্দীন মাহমুদ প্রমুখ।

গ্রন্থক: অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। উপদেষ্টা সম্পাদক, পায়রা.নিউজ। সংবাদ পাঠক, বহির্বিশ্ব কার্যক্রম বাংলাদেশ বেতার।  প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইনস্টিটিউট অব ল্যাংগুয়েজ স্টাডিজ, বাংলাদেশ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। সাংগঠনিক সম্পাদক, আল-কুদ্স কমিটি বাংলাদেশ।