
সমীরণ বিশ্বাস:বাংলাদেশে আসন্ন খাদ্য সংকট ও সমাজিক অস্থিরতা বর্তমানে এক জটিল ও সংকটপূর্ণ সময় অতিক্রম করছে। একদিকে জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, অন্যদিকে দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী খাদ্য সংকট ও অপুষ্টির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। সরকার, ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (WFP) এবং খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে যে, দেশের ১৩টি জেলায় প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ IPC Phase 3 “Crisis” পর্যায়ের খাদ্য সংকটে রয়েছে। একইসঙ্গে ১৬ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টির ঝুঁকিতে রয়েছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ভয়াবহ সংকেত।
খাদ্য সংকটের প্রকৃতি ও বিস্তার:
IPC (Integrated Food Security Phase Classification) অনুযায়ী, Phase 3 “Crisis” পর্যায় মানে হলো, মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে, এবং জরুরি সহায়তা ছাড়া তারা টিকে থাকতে পারবে না। এই পর্যায়ে থাকা জনগোষ্ঠী খাদ্য গ্রহণে বাধাগ্রস্ত, পুষ্টিহীন, এবং জীবিকা নির্বাহে চরম দুর্দশায় রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৬টি জেলায় খাদ্য সংকটের ঝুঁকি রয়েছে, যার মধ্যে ১৩টি জেলা সবচেয়ে বেশি বিপদে। এই সংকট শুধু স্থানীয় জনগণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং কক্সবাজারে অবস্থানরত ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে।
মূল কারণসমূহ: দ্রব্যমূল্য, আয় বৈষম্য ও সমাজিক অস্থিরতা:
খাদ্য সংকটের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। সাধারণ মানুষের ভাষ্য অনুযায়ী, দৈনিক ৫০০ টাকা প্রয়োজন হলেও বর্তমানে আয় হচ্ছে মাত্র ৩০০ টাকা। এই আয় দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকা এক কঠিন চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। কৃষক, দিনমজুর, নিম্ন আয়ের মানুষ, সবাই একই রকম সংকটে রয়েছেন। বাজারে চাল, ডাল, তেল, সবজি, সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় খাদ্য গ্রহণের সক্ষমতা কমে গেছে।
সমাজিক অস্থিরতাও এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। নির্বাচনের সময় সমাজিক-রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উত্তেজনা, মব, অবরোধ, সহিংসতা ইত্যাদি কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধীরগতি তৈরি হয়েছে। মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা কাজ হারাচ্ছেন, বেকারত্ব বাড়ছে, এবং দারিদ্র্য আরও গভীর হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকট শুধু একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, বরং এটি একটি সামাজিক সংকটেও রূপ নিচ্ছে।
সরকারি উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতা:
বাংলাদেশ সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি চালু করেছে, যেমন, সেফটিনেট প্রোগ্রাম, খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি, নগদ সহায়তা ইত্যাদি। তবে এই উদ্যোগগুলো শহরকেন্দ্রিক এবং অনেক সময় সংকটপূর্ণ এলাকাগুলোকে যথাযথভাবে কাভার করতে পারে না। গবেষণায় দেখা গেছে, সরকার যদি ৩৬টি ঝুঁকিপূর্ণ জেলায় টার্গেটেড খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি জোরদার করে, তাহলে সংকট অনেকাংশে কমে আসতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের উচিত এখনই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শুধু শহরভিত্তিক নয়, বরং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে খাদ্য বিতরণ, পুষ্টি সহায়তা এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।
সমাজিক স্থিতিশীলতা ও সংকট নিরসনে:
খাদ্য সংকটের সমাধানে সমাজিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। অরাজনৈতিক সরকার থাকার কারণে ব্যবসায়িক আস্থা কমে গেছে, বিনিয়োগ থমকে গেছে, এবং কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। নির্বাচিত ও জবাবদিহিমূলক সরকার না থাকলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই গবেষকরা মনে করেন, একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনই হতে পারে সংকট থেকে উত্তরণের প্রথম ধাপ।
রাজনীতিবিদদের উচিত দেশের খাদ্য সংকট, দ্রব্যমূল্য, কৃষকের দুর্দশা, নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনমান, এই বিষয়গুলোকে আলোচনার কেন্দ্রে আনা। শুধু ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা নয়, বরং জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনা থাকা উচিত।
সম্ভাব্য সমাধান ও সুপারিশ:
খাদ্য সংকট নিরসনে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে: টার্গেটেড খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি: IPC অনুযায়ী সংকটপূর্ণ জেলাগুলোতে জরুরি খাদ্য সহায়তা পৌঁছানো। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ: বাজার মনিটরিং, ভর্তুকি প্রদান, এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ। পুষ্টি সহায়তা: শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য বিশেষ পুষ্টি কর্মসূচি চালু করা। রাজনৈতিক সংলাপ ও স্থিতিশীলতা: সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা: আন্তর্জাতিক সহায়তা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্য সংকট একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যার সমাধান শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রয়োজন। আগামির ভাবনা সামনে রেখে সরকার, রাজনৈতিক দল, উন্নয়ন সহযোগী এবং নাগরিক সমাজের উচিত একসঙ্গে কাজ করা। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু একটি মানবিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত।
লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।