ধানে ফুল ফোটার সময় সতর্ক থাকুন !

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

সমীরণ বিশ্বাস:
গবেষণামূলক বিশ্লেষণ: ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। এদেশের কৃষি অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা বহুলাংশে ধানের উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। ধানের জীবনচক্রে ফুল ফোটার সময় (Flowering Stage) হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ধাপ। এই সময়ে সামান্য অবহেলাও কৃষকের সারা বছরের পরিশ্রমকে ব্যর্থ করতে পারে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের পরীক্ষণ এবং মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, এই সময়ে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে ফলনের পরিমাণ ও মান উভয়ই বৃদ্ধি পায়।

নিচে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও গবেষণার আলোকে ধানের ফুল ফোটার সময় সতর্কতাগুলো বিশ্লেষণ করা হলো;

বিষ স্প্রে বন্ধ রাখা:

ধান গাছে ফুল ফোটার সময় কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক স্প্রে করলে মারাত্মক ক্ষতি হয়। গবেষণা বলছে, কীটনাশকের সক্রিয় রাসায়নিক উপাদান পরাগরেণুকে (Pollen Grain) ধ্বংস করে দেয়, ফলে পরাগায়ন ব্যাহত হয়। ব্রি (বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট) এর মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষায় দেখা গেছে, ফুল ফোটার সময় কীটনাশক প্রয়োগ করা হলে গড়ে ২৫–৪০% পর্যন্ত দানা চিটা হয়ে যায়। এর ফলে কৃষকের প্রত্যাশিত উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যায়। তাই ফুল ফোটার পর্যায়ে কোনো ধরনের রাসায়নিক স্প্রে থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা অত্যাবশ্যক।

হাঁটা-চলা ও নড়াচড়া সীমিত করা:

ফুল ফোটার সময় ধান গাছে যে পরাগরেণু তৈরি হয়, তা খুবই সূক্ষ্ম ও নাজুক। জমিতে ঘন ঘন হাঁটা-চলা করলে গাছ কাঁপে এবং পরাগরেণু ঝরে পড়ে। আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র IRRI-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, পরাগরেণু ঝরে গেলে দানার গঠন ব্যাহত হয় এবং গড়ে ১৫–২০% ফলন হ্রাস পায়। এজন্য ফুল ফোটার সময় জমিতে অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। কৃষকের ধৈর্য এই সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পরাগায়নের ‘গোল্ডেন টাইম:

ধান গাছে ফুল ফোটে সাধারণত সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে। এটিই ধানের স্বাভাবিক পরাগায়ন বা ‘গোল্ডেন টাইম’। এ সময় জমিতে প্রবেশ করলে গাছ নড়াচড়ার কারণে বা বাইরের পরিবেশগত প্রভাবে পরাগরেণুর স্বাভাবিক মিলন ব্যাহত হয়। গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, এ সময় জমিতে যান্ত্রিক কার্যক্রম বা শ্রমিকদের চলাফেরা করলে গড়ে ৩০% পর্যন্ত দানা অপূর্ণ থাকতে পারে। তাই জমিতে প্রবেশের সঠিক সময় হলো সকাল ৯টার আগে অথবা বিকেল ৪টার পরে।

পরাগায়নে পানির গুরুত্ব:

ধান গাছে ফুল ফোটার সময়টা সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এ সময় পর্যাপ্ত পানি না থাকলে পরাগায়ন ব্যাহত হয়, ফলে ধানে চিটা দানা বেড়ে যায় এবং ফলন কমে যায়। মাটিতে আর্দ্রতার অভাবে শিষের ভেতর দানা পূর্ণতা পায় না। আবার অতিরিক্ত পানি থাকলেও শিকড়ে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়, যা গাছের ক্ষতি করে। তাই ফুল ফোটার সময় জমিতে সবসময় আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে, মাটি যেন কাদা না হয়, আবার শুকিয়েও না যায়। সঠিক পানির ব্যবস্থাপনা ধানের শিষে পূর্ণ দানা গঠনে সহায়তা করে এবং ফলন নিশ্চিত করে।

পরিবেশ ও আবহাওয়া প্রভাব:

পরাগায়ন প্রক্রিয়া শুধু কৃষকের আচরণের উপর নয়, পরিবেশ ও আবহাওয়ার উপরও নির্ভরশীল। উচ্চ তাপমাত্রা, অতিরিক্ত বাতাস বা অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ফুল ফোটার সময় ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণা বলছে, ৩৫° সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় পরাগরেণুর জীবনীশক্তি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তাই কৃষককে আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী জমি ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

ধানের ফুল ফোটার সময়কাল হলো প্রকৃতপক্ষে ‘বিয়ের সময়’, যেখানে গাছের পরাগরেণু ও গর্ভকেশরের মিলনের মাধ্যমে দানা তৈরি হয়। এই সময় অযথা স্প্রে, জমিতে অতি চলাচল কিংবা সময়জ্ঞানহীন কার্যকলাপ ফসলের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, সঠিক সতর্কতা অবলম্বন করলে চিটা ধানের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এবং ফলন ২০–৩০% পর্যন্ত বাড়তে পারে। তাই কৃষকদের উচিত এই স্পর্শকাতর সময়ে ধৈর্য ও সচেতনতা প্রদর্শন করা। সামান্য সতর্কতা কৃষকের স্বপ্নের বাম্পার ফলন নিশ্চিত করতে পারে।

লেখক:কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ , ঢাকা।