বিশ্ব জুনোসিস দিবস ২০২৫: একসূত্রে গাঁথা মানুষের স্বাস্থ্য, প্রাণীর কল্যাণ ও পৃথিবীর ভারসাম্য

Category: গবেষণা ফিচার Written by Shafiul Azam

রোটারিয়ান ড. মো: হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ, পাস্ট প্রেসিডেন্ট, রোটারি ক্লাব অব রাজশাহী সেন্ট্রাল

পরিচয়:
জুলাই মাসের ৬ তারিখ। ১৮৮৫ সালের এই দিনেই লুই পাস্তুর মানব ইতিহাসে প্রথম সফলভাবে জলাতঙ্কের টিকা প্রয়োগ করেন। জলাতঙ্ক, যা একটি ভয়াবহ জুনোটিক বা প্রাণীবাহিত রোগ, তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের এই যুগান্তকারী বিজয়কে স্মরণ করেই প্রতি বছর ৬ জুলাই পালিত হয় বিশ্ব জুনোসিস দিবস। ২০২৫ সালে আমরা এই দিবসটির ১৪০তম বর্ষপূর্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু শুধু অতীতের সাফল্যকে স্মরণ করাই নয়, এই দিবসের প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত আছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে দাঁড়ানো জুনোটিক রোগগুলোর ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রতিরোধ কৌশল শক্তিশালীকরণ এবং ‘এক স্বাস্থ্য’ (One Health) দর্শনের আলোকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের মধ্যে।

জুনোসিসশব্দের জন্ম ধারণার বিবর্তন:
‘জুনোসিস’ (Zoonosis) শব্দটির জন্ম দিয়েছিলেন জার্মান চিকিৎসক ও প্যাথলজিস্ট রুডলফ ভির্চো (Rudolf Virchow)। শূকরের দেহে ট্রাইকিনেলা স্পাইরালিস (Trichinella spiralis) নামক কৃমি নিয়ে গবেষণার সময় তিনি মানুষ ও পশুচিকিৎসা বিজ্ঞানের মধ্যে অদৃশ্য কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী সংযোগটি উপলব্ধি করেন। তিনিই প্রথম এই ধারণাটি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন যে অনেক সংক্রামক রোগ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাণীজগৎ থেকে মানবদেহে এবং কখনও কখনও মানবদেহ থেকে প্রাণীজগতে ছড়াতে পারে। এই দ্বিমুখী সংক্রমণের ধারণাকে সংক্ষেপে প্রকাশ করতেই তিনি ‘জুনোসিস’ (প্রাণী + রোগ) শব্দটি প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে উইলিয়াম অসলার (William Osler) সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও এই ধারণাকে সমৃদ্ধ করেন। সহজ বাংলায় বলতে গেলে, জুনোটিক রোগগুলো হলো সেইসব সংক্রামক ব্যাধি যার জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, পরজীবী, প্রিয়ন) প্রাকৃতিকভাবে প্রাণীদেহে বাস করে এবং তা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে। মানুষ এই সংক্রমণের শিকারে পরিণত হয় প্রায়শই ‘দুর্ঘটনাক্রমে’ বা অনিচ্ছাকৃতভাবে, যখন সে সংক্রমিত প্রাণী, তাদের মলমূত্র, লালা, রক্ত, টিস্যু বা তাদের আবাসস্থলের (যেমন দূষিত পানি, মাটি) সংস্পর্শে আসে।

জুনোটিক রোগ: একটি বিশাল বৈচিত্র্যপূর্ণ হুমকি:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের মধ্যে পরিচিত সমস্ত সংক্রামক রোগের প্রায় ৬০% এবং সাম্প্রতিক দশকগুলিতে আবিষ্কৃত নতুন সংক্রামক রোগগুলোর ৭৫% এরও বেশি জুনোটিক উৎস থেকে এসেছে। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রোগের সংখ্যা ২০০-রও বেশি! কিছু রোগ আমাদের অতি পরিচিত, কিছু আবার অপেক্ষাকৃত কম শোনা:

  1. ভাইরাসঘটিত: জলাতঙ্ক (Rabies), ইবোলা ভাইরাস ডিজিজ (EVD), বার্ড ফ্লু (Avian Influenza - H5N1, H7N9), সোয়াইন ফ্লু (H1N1), মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (MERS), সার্স-কোভ-২ (SARS-CoV-2 - COVID-19), জিকা ভাইরাস, ডেঙ্গু, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, লাসা জ্বর।
  2. ব্যাকটেরিয়াঘটিত: অ্যানথ্রাক্স (Anthrax), ব্রুসেলোসিস (Brucellosis - Malta Fever), লেপ্টোস্পাইরোসিস (Leptospirosis), স্যালমোনেলোসিস (Salmonellosis), ক্যাম্পাইলোব্যাক্টেরিওসিস (Campylobacteriosis), প্লেগ (Plague), কিউ জ্বর (Q Fever), লাইম ডিজিজ (Lyme Disease), টিউবারকিউলোসিস (TB - বিশেষ করে গবাদি পশু থেকে)।
  3. পরজীবীঘটিত: টক্সোপ্লাজমোসিস (Toxoplasmosis - বিশেষ করে গৃহপালিত বিড়াল থেকে), লেশম্যানিয়াসিস (Leishmaniasis), ক্রিপ্টোস্পোরিডিওসিস (Cryptosporidiosis), জিয়ার্ডিয়াসিস (Giardiasis), একাইনোককোসিস (Echinococcosis - হাইডাটিড ডিজিজ), ট্রাইকিনেলোসিস (Trichinellosis)।
  4. ছত্রাকঘটিত: ডার্মাটোফাইটোসিস (Dermatophytosis - Ringworm), হিস্টোপ্লাজমোসিস (Histoplasmosis - বিশেষ করে পাখির বিষ্ঠা থেকে)।
  5. প্রিয়নঘটিত: ক্রয়ট্সফেল্ট-জ্যাকব ডিজিজের (Creutzfeldt-Jakob Disease - CJD) কিছু ধরন (বোভাইন স্পঞ্জিফর্ম এনসেফালোপ্যাথি বা BSE/"ম্যাড কাউ ডিজিজ" এর সাথে যুক্ত)।

কাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি?
যদিও যে কেউই জুনোটিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে, কিছু জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি:

রোগ নির্ণয়: সূক্ষ্ম অনুসন্ধানের পথ:
জুনোটিক রোগের লক্ষণ প্রায়শই অন্যান্য সাধারণ রোগের মতো (জ্বর, মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা, দুর্বলতা, ডায়রিয়া ইত্যাদি) হওয়ায় সঠিক নির্ণয় কঠিন হতে পারে। চিকিৎসক রোগীর ইতিহাস (পোষ্য প্রাণী, ভ্রমণ, পেশা, প্রাণীর সংস্পর্শ), শারীরিক পরীক্ষা এবং বিশেষ ল্যাব পরীক্ষার সমন্বয়ে রোগ শনাক্ত করেন:

  1. প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ (Microscopy): রক্ত, মল, মূত্র, CSF (সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড), ফোঁড়া থেকে নেয়া পুঁজ বা টিস্যুর নমুনা মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে জীবাণু (পরজীবী, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকের কিছু ধরন) দেখা।
  2. কালচার (Culture): নমুনাকে বিশেষ পুষ্টিমাধ্যমে (Culture Media) রাখা হয় যাতে নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের বৃদ্ধি ঘটে এবং শনাক্ত করা যায়।
  3. সিরোলজিক্যাল টেস্ট (Serological Tests): রোগীর রক্তে নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি শনাক্ত করা (ELISA, Agglutination Tests ইত্যাদি)।
  4. পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (PCR): নমুনায় জীবাণুর জেনেটিক উপাদান (DNA/RNA) শনাক্ত করা। এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও দ্রুত পদ্ধতি, বিশেষ করে ভাইরাস শনাক্তকরণে।
  5. ইমেজিং (X-ray, Ultrasound, CT Scan): কিছু জুনোসিসের ক্ষেত্রে (যেমন একাইনোকক্কোসিসে লিভারে সিস্ট) অঙ্গের ক্ষতি মূল্যায়ণ করতে সাহায্য করে।
  6. বায়োপসি (Biopsy): সংক্রমিত টিস্যুর একটি ক্ষুদ্র নমুনা পরীক্ষা করা।

চিকিৎসা: কারণ অনুযায়ী ব্যবস্থা:
রোগ সঠিকভাবে শনাক্ত হওয়ার পরই যথাযথ চিকিৎসা শুরু করা যায়, যার লক্ষ্য জীবাণু নির্মূল করা বা তার বিস্তার রোধ করা এবং উপসর্গ প্রশমন করা। চিকিৎসা নির্ভর করে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর প্রকৃতির উপর:

প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ: শিকল ভাঙার কৌশল:
জুনোটিক রোগের বিস্তার রোধ করার মূলনীতি হলো সংক্রমণের শিকলটিকে তার সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় ভেঙে দেয়া। এই শিকলের তিনটি প্রধান অংশ:

  1. রিজার্ভয়ার (Reservoir): যে প্রাণীর দেহে জীবাণু স্বাভাবিকভাবে বাস করে (যেমন: জলাতঙ্কের জন্য কুকুর, বিড়াল, বাদুড়; প্লেগের জন্য ইঁদুর; বার্ড ফ্লুর জন্য জলচর পাখি)।
  2. সংক্রমণের মাধ্যম (Mode of Transmission): কীভাবে জীবাণু রিজার্ভয়ার থেকে সংবেদনশীল মানুষ বা প্রাণীতে পৌঁছায় (সরাসরি স্পর্শ, দূষিত খাদ্য/পানি, বায়ুবাহিত, ভেক্টর/বাহক যেমন মশা, মাছি, টিক, কামড়)।
  3. সংবেদনশীল পোষক (Susceptible Host): যে ব্যক্তি বা প্রাণী সংক্রমিত হতে পারে।

প্রতিরোধ কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে:

এক স্বাস্থ্য’ (One Health): ভবিষ্যতের রোডম্যাপ:
জুনোটিক রোগের জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গতানুগতিক পৃথক পন্থা (শুধু মানব স্বাস্থ্য বা শুধু পশু স্বাস্থ্য) যথেষ্ট নয়। এখানেই এক স্বাস্থ্য ধারণাটি অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এটি একটি সমন্বিত, একীভূত এবং টেকসই পন্থা যা স্বীকার করে যে মানুষের স্বাস্থ্য, গৃহপালিত বন্যপ্রাণীর স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্য (Ecosystem Health) গভীরভাবে এবং অবিচ্ছেদ্যভাবে পরস্পরের সাথে জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, নগরায়ন, বিশ্বায়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন এসেছে, যার ফলে নতুন নতুন জুনোটিক রোগের উৎপত্তি ও বিস্তারের ঝুঁকি বেড়েছে।

এক স্বাস্থ্যপন্থার মূল স্তম্ভগুলো হলো:

  1. যোগাযোগ (Communication): মানব স্বাস্থ্য, পশু স্বাস্থ্য, পরিবেশ, কৃষি, বন্যপ্রাণী, শিক্ষা ও নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষের মধ্যে তথ্যের অবাধ ও কার্যকর প্রবাহ নিশ্চিত করা।
  2. সমন্বয় (Coordination): বিভিন্ন খাতের মধ্যে কার্যক্রম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সমন্বয় সাধন করা যাতে সম্পদের সদ্ব্যবহার হয় এবং প্রচেষ্টা দ্বিগুণ না হয়।
  3. সহযোগিতা (Collaboration): যৌথ গবেষণা, যৌথ নজরদারি ব্যবস্থা, যৌথ জরুরি প্রতিক্রিয়া দল গঠন এবং যৌথভাবে জনসচেতনতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা।

এক স্বাস্থ্যপন্থার সুবিধা:

বিশ্ব জুনোসিস দিবস ২০২৫: আমাদের অঙ্গীকার:
২০২৫ সালের বিশ্ব জুনোসিস দিবস কেবল একটি স্মরণ দিবস নয়, এটি একটি কর্মদিবস হওয়া উচিত। লুই পাস্তুর ও রুডলফ ভির্চোর উত্তরাধিকারকে ধারণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে:

উপসংহার:
বিশ্ব জুনোসিস দিবস ২০২৫ আমাদের কাছে একটি সুস্পষ্ট বার্তা বহন করে আনে: মানুষের স্বাস্থ্য পৃথক কোনো সত্তা নয়। এটি প্রাণীকূলের স্বাস্থ্য এবং আমাদের এই গ্রহের স্বাস্থ্যের সাথে একই সুতোয় গাঁথা। জলাতঙ্কের বিরুদ্ধে পাস্তুরের প্রথম টিকার সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত থেকে আজ পর্যন্ত আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, কিন্তু নতুন নতুন জুনোটিক রোগের উত্থান (যেমন কোভিড-১৯) প্রমাণ করে যে এই যাত্রা শেষ হয়নি। জুনোটিক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই কোনো একক বিভাগ বা পেশার দায়িত্ব নয়। এটি আমাদের সকলের – ব্যক্তি, পরিবার, সম্প্রদায়, কৃষক, পশুচিকিৎসক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, নীতিনির্ধারক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর – সম্মিলিত দায়িত্ব। ‘এক স্বাস্থ্য’ দর্শনের আলোকে সমন্বিত প্রচেষ্টাই পারে আমাদের একটি নিরাপদতর, স্বাস্থ্যবানতর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সাহায্য করতে, যেখানে মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতি সম্মিলিতভাবে সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে। আসুন, ২০২৫ সালের বিশ্ব জুনোসিস দিবসে আমরা এই সম্মিলিত অঙ্গীকারে আবদ্ধ হই।