১৩ই ফেব্রুয়ারী কৃষিবিদ দিবস-দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় কৃষিবিদদের ভূমিকা অনস্বীকার্য

Category: গবেষণা ফিচার Written by agrilife24

কৃষিবিদ ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন:কৃষিই কৃষ্টি। কৃষিই সমৃদ্ধি। কৃষিকে ঘিরেই সভ্যতার জাগরণ শুরু। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কৃষির কোন বিকল্প নেই। কৃষি পৃথিবীর মূূল চালিকা শক্তি। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বিনোদনের অধিকাংশ উপাদান আসে কৃষি থেকে। খাদ্যের একমাত্র উৎস কৃষি। আর কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখেছে কৃষক ও কৃষিবিদরা।

দেশে সবচেয়ে বেশি সফলতা অর্জন হয়েছে কৃষিতে। ৪৪ বছরে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। জমি কমেছে অথচ খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণ। কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য অপরিসীম এ কথাটি অস্বীকারের কোন উপায় নেই। ফল ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ শুধু সাফল্যই নয় বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বেশ কয়েক বছর থেকেই বাংলাদেশ সফলতার সাথে সবজি রফতানি করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। আম উৎপাদনেও চমক লাগিয়ে আমরা এখন সুস্বাদু ও বাহারী আমকে রপ্তানি করছি। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। গত কয়েক বছরে মŤস্য সেক্টরের অভাবনীয় অগ্রগতি পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। প্রাণীজ আমিষ উৎপাদন অনেকগুণ বেড়েছে, ডিম-দুধের সহজ যোগানে পুষ্টির চাহিদাকে মিটাচ্ছে। শুধু তাই নয়, করোনার কারণে অর্থনৈতিক মন্দায় অনেক খাতই যখন বিপর্যস্ত তখন একমাত্র কৃষিই আমাদেরকে বŧাচিয়ে রেখেছে।   

আর এসব সম্ভব হয়েছে আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে। কৃষি  প্রধান বাংলাদেশের শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণসহ নানামুখী কাজে নিয়োজিত রয়েছে স্বনামধন্য কৃষিবিদিবৃন্দ। সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়ে জনগণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার বলয় রচনা ও সুরক্ষা এবং সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার সুবাদে কৃষিবিদগণ আজ সর্বজন স্বীকৃত। স্বীকৃতির এই মর্যাদা অর্জনের পথ মোটেই মসৃণ বা সুগম ছিল না। ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়), ময়মনসিংহ এর প্রতিষ্ঠা এবং ষাটের দশকের মধ্যভাগে এই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ও তৎকালীন ঢাকাস্থ তেজগাঁও কৃষি কলেজের (বর্তমান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্রদের ২ দফা ভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে এ লড়াইয়ের সূচনা হয়।
দুই দফা দাবির অর্ন্তভুক্ত ছিল- ১) কৃষি গ্রাজুয়েটদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশকালে গেজেটেড পদমর্যদা প্রদান ও ২) সমমর্যদার পেশাজীবীদের সাথে একীভূত বেতন স্কেল ও সংগতিপূর্ণ টেকনিক্যাল পে প্রদান।

এই দুই দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ১৯৬৪ সালের ১৭ জুন থেকে ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয় যা লাগাতারভাবে ১৭২ দিন অব্যাহত থাকে। মলয় বৈশ্য নামে একজন ছাত্রকে আত্মাহুতি দিতে হয় এ আন্দোলনে। এরকম নানান চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ঐতিহাসিক নির্দেশনায় ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নেতৃবৃন্দ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে কাছে কৃষি গ্রাজুয়েটদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশপদে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা এবং টেকনিক্যাল পে প্রদানের দাবি জানালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা মেনে নিয়ে অচিরেই সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়ন করেন। এই ঐতিহাসিক অর্জনের স্মৃতিময় ১৩ ফেব্রুয়ারি দিনটি কৃষিবিদ সমাজের জন্য এক গৌরবদীপ্ত ও অবিস্মরণীয় দিন।

এই অর্জনের দীর্ঘকাল পরে ২০১১-১২ মেয়াদে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি ১৩ ফেব্রেুয়ারি দিনটি প্রতি বছর কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত  গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্তের আলোকে ২০১১ সাল থেকে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ ১৩ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে মর্যাদার সাথে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ‘কৃষিবিদ দিবস’ হিসাবে পালন করে আসছে।  

বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম কৃষিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এ দেশের কৃষক সমাজের কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করেন। কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে প্রণয়ন করেন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা। আধুনিক কৃষিকে ধারণ ও লালন করার যোগ্য কাঠামো-অবকাঠামো তৈরিতে মনোযোগী হন। কৃষিশিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ ও উপকরণ বিতরণ কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। মৎস্য ও পশু সম্পদ এবং চা উন্নয়ন ক্ষেত্রেও নতুন নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা ঘোষণা কালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আন্দোলন করছিস বলে আমি দাবি মেনে নিলাম তা নয়, আমি চাই ভালো ছাত্রছাত্রী কৃষি পড়ুক’  আমি তোদের দাবি মেনে নিলাম তোরা আমার মুখ রাখিস।’

আমরা এখন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের পথে হŧাটছি। এদেশর কৃষিবিদ সমাজ তাদের প্রতিভা, মেধা ও কর্মদক্ষতা, সর্বোচ্চ অঙ্গীকার ও আন্তরিকতার সাথে প্রয়োগ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে ব্রতী হন। সেই থেকে এদেশের কৃষিবিদগণ বিভিন্ন ফসলের শত শত জাত উদ্ভাবন ও প্রবর্তন এবং উন্নত চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছেন। আর এ কারণেই আমাদের জমি ক্রমহ্রাসমান হলেও প্রতিবছর উৎপাদন বেড়েই চলছে। আজ এদেশের প্রতি ইঞ্চি জমি ভরে উঠেছে ফসলের বৈচিত্র্যে। শত শত উচ্চফলনশীল ফসল সংযুক্ত হয়েছে শস্য বিন্যাসে। সবজি, ফল ও মসলা উৎপাদনেও বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। শস্যের গড় নিবিড়তা শতকরা ২০০ ভাগ ছুঁই ছুঁই করছে। কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণা ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ফলে দেশ আজ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির বিভিন্ন সূচকে বিশ্বের জন্য পথিকৃৎ। কৃষি ক্ষেত্রে লাগাতরভাবে উচ্চ  প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক বৈরিতার সাথে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী জাত তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছেন কৃষিবিদরা। একই ভাবে প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতেও উন্নতির ছোয়া পিছিয়ে নেই। গ্রামে গ্রামে পোলট্রি ফার্ম, গাভি পালন, গরু মোটাতাজাকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে পশু সম্পদের এবং পুকুর, বিল, বাওড় এবং মুক্ত জলাশয়ে মাছ চাষের কার্যক্রম বিস্তৃত হওয়ায় এ খাতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। সমুদ্র জয়ের ফলে মেরিন ফিশারিজ খাতের উন্নয়নে বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি বসতবাড়িতে ফল ও সবজি চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় পারিবারিক পুষ্টির প্রাপ্যতা বেড়েছে। দেশে কৃষি শিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ সেবা যেমন সম্প্রসাারিত হচ্ছে তেমনি প্রয়োজনীয় উন্নত প্রযুক্তি ও উপকরণের যোগানও বাড়ছে প্রতিনিয়ত যেখানে বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত রয়েছেন কৃষিবিদগণ। আর কৃষি ব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের ছোঁয়া লাগায় কৃষকের জীবন মান এবং কৃষি ব্যবস্থায়ও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

কৃষিক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য অগ্রযাত্রার পরও কৃষিবিদদের নানান দুঃখ কষ্টের যেন অন্ত:নেই। আন্ত:ক্যাডার বৈষম্য কিছুটা কমে আসলেও এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে কৃষিবিদদের রয়েছে নানান বাধা ও বিপত্তি। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতিতে রয়েছে ধীরগতি। এ বছর ছয়টি চিনিকলে উৎপাদন বন্ধ থাকায় বিপাকে রয়েছে বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প কর্পোরেশনে কর্মরত কৃষিবিদরা। এছাড়া বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্পসহ অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরে যাওয়া কৃষিবিজ্ঞানীরা তাদের পাওনা টাকার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। করোনার প্রভাবে বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কৃষিবিদরা রয়েছেন আরো নানান বিপাকে। সরকারী ও বেসরকারী মিলিয়ে ১০টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাসকৃত কয়েক হাজার কৃষিবিদ এখন বেকার, আর প্রতিবছরই এ সংখ্যাও বাড়ছে। এসব সমস্যাগুলোর আশু সুরাহা না হলে টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।

সব বাঁধা পেরিয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে কৃষি ক্ষেত্রে অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য কৃষিবিদদের ভূমিকা আরো শানিত ও জোরদার হবে মুজিব শতবর্ষে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক-অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান,কৃষি রসায়ন বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.